নিম্নবর্গ বিশেষজ্ঞ রণজিত গুহের দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা

উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ বলতে কী বোঝায়, এ পর্যন্ত তার কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিনি। তবু এই শব্দ দুটি যে ঔপনিবেশিক সমাজের মধ্যে একটা মৌলিক ভেদের স্থূল সংকেত হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, সে বিষয়ে কারও ভুল হবার কথা নয় । আমার বাকি বক্তব্যের প্রস্তাবনা করছি ওই দুটি শব্দের সংজ্ঞা দিয়ে ।
উচ্চবর্গ বলতে আমি বোঝাতে চাই তাদেরই, ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিল। প্রভুস্থানীয়দের দু-ভাগে ভাগ করা যায়-বিদেশি ও দেশি। বিদেশি প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যে যারা এই সংজ্ঞাসম্মত তারাও দু-ধরনের-সরকারি ও বেসরকারি। সরকারি বলতে গণ্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলেই; আর বেসরকারি বলতে গণ্য বিদেশিদের মধ্যে যারা শিল্পপতি, বণিক, অর্থব্যবসায়ী, খনির মালিক, জমিদার, নীলকুঠি চা-বাগান কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লানটেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিষ্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি ।
দেশি প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যেও একটা ভাগ ছিল সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের পার্থক্য অনুযায়ী। সর্বভারতীয়দের গণ্য বৃহত্তম সামন্ত প্রভুরা, শিল্পে ও বাণিজ্যে লিপ্ত সবচেয়ে শক্তিমান বুর্জোয়ারা এবং ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রে বা শাসনযন্ত্রের অন্যত্র যারা ছিল সবচেয়ে উচ্চপদের অধিকারী।
দেশি প্রভুগোষ্ঠীর আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিরাও আবার দু-রকমের । এক রকম হচ্ছে তারাই যারা আসলে সর্বভারতীয় প্রভুগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতাবিন্যাসের আঞ্চলিক বা স্থানীয় উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এক রকম হচ্ছে তারা যাদের প্রভুত্ব ষোলো আনাই আঞ্চলিক বা স্থানীয় কিংবা যারা অন্য সব অর্থে প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যে গণ্য না হলেও আঞ্চলিক বা স্থানীয় অবস্থায় প্রভুগোষ্ঠীর স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কাজ করে, নিজেদের সামাজিক সত্তার ধর্ম অনুযায়ী কাজ করে না ।
এই শেষোক্তদের, অর্থাৎ দেশীয় প্রভুগোষ্ঠীর স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের সম্পর্কে একটা কথা কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার। কথাটা এই যে সামগ্রিক ও শুদ্ধ অর্থে উচ্চবর্গের এই অংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার অসমতা, এবং সেই অসমতার কারণ দ্বিবিধ: এক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের আঞ্চলিক বৈষম্য;
আর দুই-এই অংশটির সামাজিক গড়নের সাংকর্য, অর্থাৎ তার অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলোর মধ্যে গুণগত পার্থক্য। এই দ্বিবিধ অসমতার ফলেই যে শ্রেণি বা সমূহ এক অঞ্চলে প্রভুস্থানীয় বলে গণ্য তারাই আবার অন্যত্র আর এক প্রভুগোষ্ঠীর অধীন। একাধারে প্রভুত্ব ও অধীনতার প্রতীক বলেই তাদের মানসিকতা, রাজনৈতিক আদর্শ ও আচরণ, সখ্য ও শত্রুতার ঝোঁক বা তাৎপর্য সবক্ষেত্রেই এক নয়, বরং অর্থ ও উদ্দেশ্যের নানারকম স্ববিরোধিতায় তা প্রায়শই অস্পষ্ট ও জটিল হয়ে দেখা দেয়। ঔপনিবেশিক যুগে ভুস্বামীদের মধ্যে যারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে, গ্রামভদ্রদের মধ্যে যারা আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতায় একটু খাটো, মাঝারি কৃষকদের মধ্যে যারা অপেক্ষকৃত উপরের দিকে এবং ধনী কৃষক শ্রেণি-এরা সকলেই আমার সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে নিম্নবর্গের অন্তর্গত হলেও বহুক্ষেত্রেই অবস্থার চাপে ও চৈতন্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে উচ্চবর্গের সপক্ষে কাজ করে। আদর্শের বিশুদ্ধতা থেকে বাস্তবের এই বিচ্যুতি ও তারই পরিণামে যে ঐতিহাসিক জটিলতার সৃষ্টি হয় তার সন্ধান, বিশ্লেষণ ও বর্ণনাই গবেষণার দায়িত্ব ।
ঔপনিবেশিক ভারতে যারা এই সংজ্ঞা অনুযায়ী উচ্চবর্গের অন্তর্গত, সমগ্ৰ জনসংখ্যা থেকে তাদের বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তারাই নিম্নবর্গ। এর মধ্যে শহরের শ্রমিক ও গরিব, সর্বোচ্চ পদের আমলাদের বাদ দিয়ে মধ্যবিত্তের বাকি অংশ, গ্রামের খেতমজুর, গরিব চাষি ও প্রায়-গরিব মাঝারি নিম্নবর্গের মধ্যে গণ্য। তাছাড়াও এই সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে গণ্য হবে নির্বিত্ত ভূস্বামী, অপেক্ষাকৃত হীনবল গ্রামভদ্র, অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন মাঝারি কৃষক এবং ধনী কৃষকরাও—যদিও, একটু আগেই যেমন বলেছি, এদের ভূমিকা স্পষ্ট নয় বরং দোটানায় জটিল এবং বাস্তবে এরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের সামাজিক সত্তার নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে উচ্চবর্গের স্বার্থ অনুযায়ী চলে ৷
আমার বক্তব্য থেকে একথা হয়তো এতক্ষণে পরিষ্কার হলো যে উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের বৈপরীত্য ব্যবহার করে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে ক্ষমতাবিন্যাসের মূল সূত্রটি সম্পর্কে একটি বিশেষ ধারণায় আমি পৌঁছাতে চাই। এই বৈপরীত্যের উপর জোর দিয়ে ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা প্রয়োজন মনে করি এই জন্য যে প্রচলিত বিশ্লেষণ-পদ্ধতিগুলোর সাহায্যে তখনকার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে সমগ্রভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়, এবং সম্ভব নয় বলেই নিম্নবর্গের ভূমিকা উপেক্ষিত হয়ে থাকে । এই পদ্ধতিগুলো দু-ধরনের: তাদের মধ্যে একটিকে বলা যায় মোটা কায়দা, অন্যটিকে মিহি কায়দা ৷
মোটা কায়দার বিশ্লেষণে শুধু ইংরেজ ও ভারতীয়দের সম্পর্কটাই রাজনীতির বিষয় বলে স্বীকৃত হয়। ফলে ঐতিহাসিক যদি বিদেশি উচ্চবর্গের পক্ষপাতী হন তা হলে ওই যুগের অভিজ্ঞতা শাসকদের অভিজ্ঞতায় আত্তীকৃত হবে, আর তিনি যদি দেশি উচ্চবর্গের পক্ষপাতী হন তা হলে তা আত্তীকৃত হবে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের চিন্তায় ও কাজে। উভয়তেই নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক চেতনা ও কর্মের কোনো স্বীকৃতি নেই I
মিহি কায়দার বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য জাতি ও শ্রেণিগত সম্পর্ক বিচার করা। সমাজের নীচের তলায় বাস্তব অবস্থা বোঝার পক্ষে মোটা কায়দার চেয়ে এটি অনেক বেশি কার্যকর। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো সামগ্রিক ধারণা তৈরি করা সম্ভব নয় কেবলমাত্র জাতভেদ ও শ্রেণিভেদের ভিত্তিতে। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ফলে জাতে-জাতে ও শ্রেণিতে- শ্রেণিতে পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারাটা সর্বত্রই এক রকমের নয়। এই অবস্থায় বিশ্লেষণের কাজ যদি ক্ষমতাবিন্যাসের একটি সাধারণ সূত্রে আশ্রয় না করে এগোয় তা হলে জাতনির্ণয় ও শ্রেণিনির্ণয় যতই সূক্ষ্ম ও চুলচেরা হবে, ঐতিহাসিক বিবৃতি ততই ব্রিত হবে অনাবশ্যক তথ্যের বহুলতায় এবং শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি হবেই একরকম অনেকত্ববাদী বা পুরালিস্ট বর্ণনায় যা আসলে অতীতকে সম্যক বোঝার দায়িত্ব এড়াবার নামান্তর মাত্র ৷
সুতরাং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির উপায় হিসেবে এমন একটা মৌলিক ও কেন্দ্রীয় ধারণা তৈরি করে এগোতে হবে যা দিয়ে ক্ষমতাসূচক সব সম্পর্কই বোঝা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যা শ্রেণিসম্পর্ক-জাত সম্পর্ক, শাসক শাসিতের সম্পর্ক ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ সম্পর্ক থেকে ভিন্ন প্রকৃতির অথচ ওই সম্পর্কগুলো সবই যার অন্তর্নির্বিষ্ট। উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের বৈপরীত্য এই রকমই একটা কেন্দ্রীয় ধারণা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সমাজে এমন কোনো অভিব্যক্তি নেই যা এই দ্ব্যণুক সম্বন্ধ দিয়ে বোঝা বা বোঝানো যায় না। জাত শ্রেণি সম্প্রদায় ও অন্যান্য সমূহের নানা অংশের মধ্যে, রাজা জা স্ত্রীপুরুষ জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ প্রভৃতির মধ্যে, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বত্র ক্ষমতাবৈষম্য সেই বৈপরীত্যের বিশেষ বিশেষ প্রকাশ। এবং তা যেমন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রকট, আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও তেমনি। এক কথায়, যুক্তিসিদ্ধ এবং প্রয়োগে নমনীয় বলেই, অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য ও সামান্যতা উভয়কেই বোধগম্য করতে পারে বলেই এই ধারণাটি এত শক্তিশালী ।
এই বৈপরীত্যের কথা মনে রাখলে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি সম্পর্কে একটা প্রচলিত এবং প্রায় স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকৃত বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে ৷ বিশ্বাসটা এই যে ভারতের রাজনৈতিক জীবনের সবটাই একটিমাত্র উপাদানে তৈরি, সেই উপাদান ইংরেজ-প্রবর্তিত উদারনৈতিক শিক্ষাসংস্কৃতি থেকে নেওয়া বা তারই প্রত্যক্ষ ফল, এবং ওই রাজনীতির ক্ষেত্রটি অখণ্ড। ইতিহাসের সব ব্যাখ্যাতেই-তা ঔপনিবেশিকতার পক্ষপাতী হোক কিংবা জাতীয়তাবাদের পক্ষপাতী হোক-সব ব্যাখ্যাতেই এই কথাটা অবিসংবাদী বলে অনুমিত হয় এবং এটাকে সত্য বলে ধরে নিয়েই বক্তব্য সাজানো হয়ে থাকে ।
কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে বিশ্বাসটা অমূলক। কারণ ইংরেজ আমলের ইতিহাস উচ্চবর্গের রাজনীতির পাশাপাশি আর একটি রাজনীতির অস্তিত্ব এতই স্পষ্ট যে সে বিষয়ে ভুল হবার উপায় নেই। সেই রাজনীতির ক্ষেত্রে নিম্নবর্গই নায়ক, উচ্চবর্গ নয়; নিম্নবর্গের প্রতিভাই সেই রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত সব চিন্তা ও কাজের চালিকা শক্তি । এক কথায়, তা রাজনীতির একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র। ক্ষেত্রটির বৈশিষ্ট্য, তার ঐতিহাসিক উৎপত্তি, সমাবেশের চরিত্র, আদর্শরূপ ও বাস্তব ভিত্তি অনুযায়ী সংক্ষেপে বর্ণনা করছি ।

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা ৮৭
প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে এই রাজনীতির মূল উপাদানগুলো ইংরেজ রাজত্ব শুরু হবার আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই অর্থে সনাতন হলেও প্রাকব্রিটিশ যুগের উচ্চবর্গীয় রাজনীতির মতো তা ঔপনিবেশিক অবস্থার চাপে নষ্ট বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। বরং নতুন অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে এবং তারই মধ্যে চেতনা ও ব্যবহারের নানা দ্বন্দ্বের ফলে আকারে ও গুণে কিছু নতুনত্ব নিয়ে তা ঔপনিবেশিক আমলের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করে গেছে-এবং এখনও বোধ হয় কাজ করে যাচ্ছে (যদিও স্বাধীন ভারতের কথা আমি বর্তমান আলোচনার বাইরে রাখতে চাই)। মোটামুটি বলা চলে যে, ঐতিহাসিক উৎপত্তি ও বিকাশের দিক থেকে বিচার করলে নিম্নবর্গের রাজনীতির ক্ষেত্রটি পুরানো হয়েও আধুনিক এবং উচ্চবর্গের রাজনীতির তুলনায় তার পরিপ্রেক্ষিতের গভীরতা ও তার সত্তার ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি ।
এই রাজনীতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নবর্গের সমাবেশের কায়দায় ও চরিত্রে। উচ্চবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশকে যদি খাড়াখাড়ি বলে বর্ণনা করা যায় তাহলে নিম্নবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশকে আড়াআড়ি বলে বর্ণনা করা চলে। ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য ইংরেজরা যেসব সংস্থা এদেশে চালু করেছিল এবং প্রাক- ঔপনিবেশিক আমলে সামন্ত শাসনের সহায়ক যেসব সংস্থা তখনও একান্ত অকেজো হয়ে যায়নি, সেগুলোই ছিল খাড়াখাড়ি সমাবেশের উপায়। কিন্তু আড়াআড়ি সমাবেশের প্রধান উপায় নিম্নবর্গের সমাজে কুটুম্বিতা ও আঞ্চলিকতার প্রত্ন বিধিব্যবস্থা কিংবা শ্রেণিসংস্থা বা এই দুই-এর নানারকম সমন্বয়। উচ্চবর্গের জমায়েতের ঝোঁক প্রধানত ছিল আইনের মধ্যে থেকে বরং আইনকে আশ্রয় করেই কাজ চালানো, আইনভঙ্গের মধ্যে যথাসাধ্য লিপ্ত না হওয়া; নিম্নবর্গের জমায়েত যথাসম্ভব আইসংগত রাস্তা ধরে এগোত ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজন হলে তা বেআইনি এমনকি হিংসাত্মক হয়ে উঠত অপেক্ষকৃত সহজে এবং আরও তাড়াতাড়ি-তাই এই জমায়েত উচ্চবর্গের কাছে অনেক সময়েই খুব অপ্রত্যাশিত ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হতো। ঔপনিবেশিক যুগে নিম্নবর্গের এই জমায়েতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও শক্তিশালী রূপ দেখা যায় তৎকালীন কৃষকবিদ্রোহগুলোতেই। শহুরে মধ্যবিত্ত, শ্রমিক বা অন্যান্য গরিব জনতার সমাবেশেও তখন ওই প্রকার বিদ্রোহী কৃষক জমায়েতের আদিকল্পটির বহু লক্ষণ স্পষ্টই চোখে পড়ে। উচ্চবর্গের পক্ষপাতী ইতিহাসবিদ্যার পক্ষে নিম্নবর্গের জমায়েতের এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্বীকার করা সম্ভব নয়, কারণ করলেই যে-আদিকল্পটি সেই ইতিহাসবিদ্যার ভিত্তি তাকে অস্বীকার করতে হয়।
এই রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য আদর্শগত। নিম্নবর্গের সামাজিক সত্তা যে সব উপাদানে তৈরি তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চৈতন্যের স্তর ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সব ক্ষেত্রে সমান নয় । তাই তাদের আদর্শগুলোর মধ্যে অমিল, এমনকি পরস্পরবিরোধিতাও ছিল, এবং তারই ফলে সেই রাজনীতির সামগ্রিক আদর্শের চেহারাটা অবস্থাভেদে এক-এক রকমের হয়ে দেখা দিত। মোটামুটি বলা চলে যে, কোনো পরিস্থিতি বা ঘটনার মধ্যে এই রাজনীতির এক বা একাধিক উপাদান যখন অন্য উপাদাগুলোর চেয়ে বড় হয়ে উঠত তখন তারই প্রভাবে অন্তত সাময়িকভাবে সেই রাজনীতির আদর্শগত গুণ ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হতো। ফলেই অবস্থাভেদে এই আদর্শের নানান ধারার মধ্যে কিছু কিছু প্রকারভেদ ও অসমতা লক্ষ করা যায়। তবে অসমতা সত্ত্বেও যা সর্বত্র প্রকট তা হচ্ছে উচ্চবর্গের প্রতি আনুগত্য ও বিরোধিতার সমন্বয়। এই দুটির আপেক্ষিক গুরুত্বেও আবার তারতম্য ছিল, কিন্তু বিরোধিতা যখন আনুগত্যকে ছাড়িয়ে যেত তখনই নিম্নবর্গের রাজনীতির মৌলিকতা এবং উচ্চবর্গের রাজনীতি থেকে তার পার্থক্য সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠত।
এই রাজনীতির চতুর্থ বৈশিষ্ট্যটির মূল্যধার প্রকৃতির দেওয়া ও মানুষের তৈরি সেই বাস্তব অবস্থা যা দিয়ে নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা, তাদের কায়িক ও মানসিক শ্রমের সংগঠন, এবং সর্বোপরি জীবিকা ও শ্রমের শর্তস্বরূপ শোষক শোষিতের ক্ষমতাগত সম্পর্কগুলো নির্ধারিত হয়। উচ্চবর্গের ইতিহাসবিদ্যায় এই সবকিছুই একটা সংকীর্ণ অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়েছে। তার পক্ষে কিছুতেই স্বীকার করা সম্ভব নয় যে সেই অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা আসলে প্রভুত্ব ও অধীনতার সূত্রে নিয়ন্ত্রিত এবং এই দুটির টানাপোড়েনেই নিম্নবর্গের রাজনীতির অনেক নকশা বোনা হয়ে থাকে ৷
নিম্নবর্গের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে এতক্ষণ যা বলেছি সে বিষয়ে দুটি কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার, নইলে অনেক বাজে তর্কে সময় নষ্ট হবে। প্রথম কথাটি হচ্ছে এই যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমি যেভাবে বর্ণনা করালাম তা তাদের শুদ্ধ রূপ । বলাইবাহুল্য যে ঔপবিনেশিক যুগের বাস্তব রাজনীতির অভিজ্ঞতার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে অবিকল এই রূপেই দেখার চেষ্টা নিরর্থক। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সাধারণ চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই এক-এক অবস্থায় এক-এক ভঙ্গিতে কাজ করবে। আমি তাদের শুদ্ধ রূপটিকেই তুলে ধরেছি শুধু এই জন্যেই যে, আমার উদ্দেশ্য একটি তাত্ত্বিক প্রস্তাবের মূলসূত্রগুলো এখানে উল্লেখ করা। কিন্তু আমিই যখন আবার কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে বসব তখন আমার কাজ হবে সেই তত্ত্বের আলোকে ওই অভিজ্ঞতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মিশ্ররূপকে পূর্বোক্ত শুদ্ধরূপের সঙ্গে তুলনা করা এবং তুলনার ফলে যে পার্থক্য ধরা পড়বে তা দিয়েই সেই ঐতিহাসিক বিষয়টার অনন্যতা বর্ণনা করা ।
এ প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে এই যে, বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা পাকা ফর্দ বানিয়ে পেশ করা আমার উদ্দেশ্য নয় এবং তা করাও সম্ভব নয়। ঔপনিবেশিক আমলের ইতিহাস নিয়ে এখন পর্যন্ত যা কাজ হয়েছে তারই ভিত্তিতে একটা সাধারণ ধারণাকে মোটা কথায় সাজিয়ে বলা গেল। গবেষণা যতই এগোবে এবং নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে চিন্তায় ও লেখায় আমাদের চেষ্টা যতই ব্যাপক ও নিপুণ হবে, বৈশিষ্ট্যগুলোর চেহারা ততই বিশদ হয়ে উঠবে। তবে একান্ত সংগত কারণেই অসমাপ্ত এই বর্ণনা থেকে একথাটা হয়তো পরিষ্কার হয়ে থাকবে যে প্রচলিত আদিকল্পটিকে আশ্রয় করে ঔপনিবেশিক আমলের রাজনীতি সম্পর্কে যে অদ্বৈতবাদী ধারণা ইতিহাসবিদ্যায় স্বতঃসিদ্ধ বলে মান্য, তা দিয়ে ওই যুগের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে সমগ্রভাবে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না, বরং সেই অদ্বৈতবাদী ধারণাটিই আসলে ওই অভিজ্ঞাতার বর্ণনায় উচ্চবর্গের প্রাধান্য কায়েম রাখার ও নিম্নবর্গের ভূমিকা অস্বীকার করার মূল শর্ত ।
এই বৈশিষ্ট্যবিচারের ভিত্তিতে তা হলে নিঃসন্দেহেই বলা চলে যে ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতির ক্ষেত্রটি দ্বিধাবিভক্ত। কিংবা অন্য উপমায় বলা যায় যে, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের চৈতন্য ও কর্মের বাহন দুটি স্বতন্ত্র ধারা বয়ে চলেছে ওই রাজনীতির মধ্যে। তবে সেই সঙ্গে একথাও বেশ জোর দিয়েই বলা দরকার যে স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও ওই ধারা দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ নয় তাদের বৈপরীত্যের জন্যই। বিপরীত বলেই যে কোনো দ্ব্যণুক সম্বন্ধের রাশি দুটির মতো তাদের একটি অপরটির অস্তিত্ব সূচনা করে, ঘোষণা করে ।
কিন্তু এই সাধারণ অর্থ ছাড়াও একটি বিশেষ অর্থে তারা সম্পৃক্ত। সম্পৃক্ত এই কারণে যে উচ্চবর্গের কোনো কোনো অংশ কখনও কখনও এই দুই ধারাকে তাদের নিজেদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে মেলাতে চেষ্টা করেছে উভয়বর্গের একত্রিত সমাবেশে । বিশেষ করে বুর্জোয়াদের চেষ্টায় এই ধরনের সমাবেশ কয়েকটি বিরাট সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের উপলক্ষ ও হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, যদিও তা সব ক্ষেত্রেই নেতাদের অভিপ্রেত ছিল এমন নয়, বরং তাদের মধ্যে আপসের মনোবৃত্তি, জঙ্গি গণআন্দোলনের তেজ সম্পর্কে তাদের ভয় এবং নিম্নবর্গের চৈতন্যের নানা দুর্বলতার ফলে এইসব লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তাদের প্রতিশ্রুতিও পূর্ণ হয়নি। আন্দোলনে ভাটা এসেছে যখন, তখনই আবার বেণীবন্ধ শিথিল হয়ে পড়েছে এবং রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা দুটি তাদের নিজ নিজ খাতে ফিরে গেছে। উচ্চবর্গের নেতৃত্বেই এই দুটি ধারা কখনও আবার মিলিত হয়েছে এমন সব জমায়েতে যা সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করা দূরে থাকুক কার্যত তাকেই সাহায্য করেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সামন্তশ্রেণির অন্তর্ঘাতী হিংস্রতার অস্ত্র হিসেবে নিম্নবর্গকে ব্যবহার করে। তবে সমাবেশের উদ্দেশ্য প্রগতির অনুকূলেই হোক বা প্রতিক্রিয়ার অনুকূলে, একথা লক্ষ করার মতো যে এই দুটি ধারা বা ক্ষেত্রের প্রতিচ্ছেদে বিস্ফোরণ ঘটেছে বারেবারেই, কারণ ঠিক তখনই উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে তারই উদ্যোগজাত আন্দোলনের মধ্যে নিম্নবর্গের রাজনীতি তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে মুদ্রিত করেছে ।
এই প্রতিচ্ছেদের বহু দৃষ্টান্ত আছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে। কিন্তু উচ্চবর্গের অগ্রণী শ্রেণি বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব সেই সব আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নিতে পারেনি, তাকে পরিণত করতে পারেনি জাতির মুক্তিযুদ্ধে এবং বুর্জোয়াশ্রেণির সর্বেশ্বরতা প্রতিষ্ঠা করে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাবার দায়িত্বও পূর্ণ করতে পারেনি।
অপরদিকে নিম্নবর্গের রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা স্বতন্ত্র উদ্যোগ গড়ে উঠেছে ঠিকই, তবু তাও জাতীয় আন্দালনকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ হয়তো ইংরেজ শাসিত ভারতের শ্রমিকশ্রেণির অপরিণত অবস্থা তার বাস্তব জীবনে ও চৈতন্যে। ফলে শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে ওঠেনি, তাদের সর্বেশ্বরতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এবং নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি 'নিম্নবর্গের মধ্যে অগ্রণী যারা তারাও ।
এই দ্বিবিধ ব্যর্থতাই ঔপনিবেশিক যুগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মর্মবস্তু ।
আমাদের চিন্তায় ও বক্তব্যে এই বিষয়টিকে যদি সম্যক গুরুত্ব দিতে হয় তাহলে ইতিহাসবিদ্যায় উচ্চবর্গের পক্ষপাতী আদিকল্পটির বিরুদ্ধে সচেতনভাবেই বিদ্রোহ করতে হবে, আমাদের সাধনাকে নতুন তাত্ত্বিকতা, নতুন তথ্য ও নতুন পদ্ধতি দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের রাজনীতির বৈপরীত্য ও তাদের সম্পৃক্তি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করতে হবে, এবং সেজন্যই নিম্নবর্গের ভূমিকাটিকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে ।
এই প্রস্তাবসম্মত কাজ অর্থাৎ গবেষণা ও লেখা ঠিক কীভাবে এগোবে তার খুঁটিনাটি আগে থেকে বর্ণনা করার চেষ্টা নিরর্থক। যে কোনো সৃষ্টিশীল প্রয়াসের মতো ইতিহাস রচনার মধ্যেও আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতের চমক হামেশাই দেখা যায় । এই আকস্মিকতা একদিকে যেমন নতুন তথ্য আবিষ্কার ও পুরানো তথ্যকে নতুনভাবে দেখার অবশ্যম্ভাবী ফল, অপরদিকে অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐতিহাসিকের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার লীলাই তার কারণ। সুতরাং নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ্যার প্রগতি কোনো ফতোয়া বা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। তবে তার মূল লক্ষ্যের দিকে চোখ রেখে দু-একটি কথা বলতে চাই যা হয়তো এই অভ্যাসের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারে ।
এই কাজে যাঁরা নামতে চান তাঁদের প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে নিম্নবর্গের ইতিহাস নিছক তথ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্গলিত হবে না। তথ্য ছাড়া ইতিহাস হয় না ঠিকই, কিন্তু তা নিছক তথ্য নয়। নিছক তথ্য আভিধানিক শব্দের মতো। ওই শব্দগুলোকে অভিধান থেকে বাছাই করে তুলে যদি বাস্যবন্ধে সাজানো যায় তবেই পারস্পরিক সম্পর্কের আলোকে তারা তাদের বিশিষ্ট অর্থে ব্যক্ত হবে। শব্দ বাছাই করা ও সাজানো যেমন বক্তার চৈতন্যের অভিব্যক্তি ভাষায়, তথ্য বাছাই করা ও সাজানো তেমনি ঐতিহাসিকের চৈতন্যের অভিব্যক্তি ইতিহাসবিদ্যায়। তথ্য বাছাই ও সাজানোর জন্য তাই একান্ত সচেতনভাবে দুটি মূল ধরে এগোলে দিগভ্রান্তির সম্ভাবনা কম। সূত্র দুটি সম্পর্কে আগেই বিস্তারিত বলা হয়েছে, তাই এখানে শুধু উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে।
এক নম্বর সূত্র :
ঔপনিবেশিক ভারতে রাজনীতি ক্ষেত্রটি অখণ্ড নয়, দ্বিধাবিভক্ত। তার মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র ধারা-উচ্চবর্গের রাজনীতির ধারা ও নিম্নবর্গের রাজনীতির ধারা। স্বতন্ত্র হলেও এই ধারা দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। তারা বৈপরীত্যে বাঁধা এবং বেণীবন্ধের মতো কখনও কখনও তারা ঐতিহাসিক প্রতিচ্ছেদে যুক্ত হয়, কখনও আবার নিজ নিজ খাতে বয়ে চলে।
দুই নম্বর সূত্র :
নিম্নবর্গের ইতিহাস শুধু ঘটনার পারম্পর্য আশ্রয় করে বোঝা বা লেখা যাবে না । ঘটনা বা সাধারণভাবে বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে উচ্চবর্গের সঙ্গে নিম্নবর্গের সম্পর্ক পরিষ্কার করে বিশ্লেষণ করতে হবে। এই সম্পর্ক আসলে প্রভুত্ব ও অধীনতার সম্পর্ক বৈপরীত্যের দ্ব্যণুক সম্পর্ক।

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা ৯১
এই দুটি সূত্র ধরে গবেষণা, আলোচনা ও রচনার বিষয়বস্তু এবং বিশ্লেষণ প্রণালি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব আমি রাখতে চাই । এই প্রস্তাবটি কোনো পাকা ‘প্রোগ্রাম’ নয়। এই সবটাই আমার ব্যক্তিগত চিন্তা অভ্যাস অভিজ্ঞতা ও রুচির অপরিণত এবং ইদানীন্তন নিদর্শন মাত্র। কাজ যত এগোবে ততই, এই প্রস্তাব আরও পরিশীলিত হবে, এবং আশা করি সকলেই নিজ নিজ চিন্তা ও অভ্যাসের সাহায্যে এটিকে বদলে ও শুধরে নেবেন ।
এই প্রসঙ্গে আমার প্রথম মন্তব্য এই যে নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত সকল শ্রেণি গোষ্ঠী ব্যক্তি ও সমূহকে ঐতিহাসিক গবেষণা ও বক্তব্যের বিষয় বলে স্বীকার করতে হবে সচেতনভাবে। এদের মধ্যে শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, গ্রাম ও শহরের গরিব জনতা ইত্যাদি গণ্য তো বটেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক সমাজে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটা যাদের জীবনে খুবই প্রকট অথচ যারা আমাদের ইতিহাসচিন্তায় এখনও প্রায় অনুপস্থিত সেই আদিবাসী, নিম্নবর্ণ ও নারীদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ করে ভাবতে ও লিখতে হবে। এইদিকে এগোতে গেলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে যে উচ্চবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি ও তার বাহন প্রচলিত আদিকল্পটি আমাদের পথ জুড়ে আছে। তাই ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের আমেদাবাদ সুতাকলে ধর্মঘটের ইতিহাস যখন লিখতে বসব তখন যেন মনে রাখি যে সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মহাত্মা গান্ধি, শংকরলাল ব্যাংকার ও অনসূয়া সারাভাইয়ের জীবনীর অধ্যায় মাত্র নয়, তার মধ্যে ধর্মঘটীদের চৈতন্যের-শ্রেণিচেতনা যার অন্যতম উপাদান-তার একটি মূল্যবান ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস মহাদেব দেশাই বা তেন্দুলকরের পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি, তা আমাদেরই লিখতে হবে একেবারে আর-এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আর একটি আদিকল্পের প্রেরণায়। এ কাজে হাত দিলে দেখা যাবে যে উনিশ শতকের কৃষকবিদ্রোহগুলোকে নেহাত উদ্দেশ্যবাদী কায়দায় বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে অঙ্গীভূত না করে তাদের স্বমহিমায় দেখতে গেলে বিদ্রোহী চৈতন্যের একটি প্রধান লক্ষণ যে ধর্মচেতনা তাকে উড়িয়ে দেওয়া তো যায়ই না যেমন একজন বামপন্থি লেখক তাঁর বহুল প্রচারিত রচনায় করেছেন, বরং ধর্মবিশ্বাসকে সেই চৈতন্যের একটি ধ্রুবগুণ বলে স্বীকার করতে হয়। এ কাজে হাত দিলেই দেখা যাবে যে রাজনৈতিক জীবনী-সাহিত্য পুরানো ইতিহাসবিদ্যার প্রভাবে শুধু উচ্চবর্গের গুণকীর্তনে মুখর; আমরা চাই যে তার মধ্যে তিতুমীর, সিদো, কানহু, মাদারি পাসীর কীর্তি উচ্চারিত হোক। আমরা এমন ইতিহাস চাই যার মধ্যে মেয়েরা অতীত সমাজের তথ্যকণিকা মাত্র নয়, যার মধ্যে তারা ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকৃত; যার মধ্যে আদিবাসীরা কৃষকদের জীবন ও আন্দোলনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হবে না, কৃষক সমাজের সবচেয়ে নিঃস্ব ও সংগ্রামী অংশ বলেই বিবেচিত হবে; যার মধ্যে বর্ণানুক্রমে নিম্নতম বলে গণ্য যারা তাদের আন্দোলনগুলোকে উচ্চবর্গের অনুকারী তথাকথিত সংস্কৃতায়নের সিঁড়ি বলেই শুধু বর্ণনা করা হবে না, বরং অনুকরণের পাশাপাশি এমনকি তার চেয়েও বেশি যে আক্রোশ ও তজ্জনিত প্রতিবাদ ওই সব আন্দোলনের স্বভাবসিদ্ধ তাও বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার বিষয় বলে মানা হবে।
আমার দ্বিতীয় মন্তব্য এই যে নিম্নবর্গের ইতিহাসে গণসমাবেশের প্রসঙ্গটিকে
বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ প্রচলিত আদিকল্পটির চাপে ইতিহাসবিদ্যার ঠিক এইখানটাতেই অনেক বিকৃতি ও অসত্যকে একেবারে স্বতঃসিদ্ধের আসনে বসানো হয়েছে। গণসমাবেশের প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতাকে তাই নতুন করে বিচার করার, নতুনভাবে তার মূল্যায়নের সময় এসেছে। যাঁরা নিম্নবর্গের ইতিহাসের এই দিকটা নিয়ে কাজ করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্যে দু-একটি কথা বিশেষ জোর দিয়ে বলতে চাই ।
(১) মনে রাখবেন যে পুরানো আদিকল্পটির প্রভাবে ইতিহাসবিদ্যায় সাধারণত সব গণসমাবেশকেই, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংক্রান্ত সমাবেশগুলোকে শুধু খাড়াখাড়ি জমায়েত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কারণ, এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উচ্চবর্গের প্রেরণা ছাড়া জনগণ কিছুতেই রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে পারে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখতে গেলে এই একদেশদর্শিতা প্রথমেই বর্জন করা দরকার। জমায়েতের মধ্যে খাড়াখাড়ি ও আড়াআড়ি এই দুটো কায়দাই কাজ করছে এই অনুমান আশ্রয় করেই গবেষণার প্রকল্প তৈরি করতে হবে। তা যদি না করেন তাহলে আড়াআড়ি জমায়েতের সাক্ষ্য চোখেই পড়বে না, বা পড়লেও তাকে খাড়াকাড়ি জমায়েতের সাক্ষ্য বলে ভুল হবে নির্ঘাত ।
(২) উচ্চবর্গের দৃষ্টিতে জনসমাবেশের অন্তর্নিহিত পার্থক্যগুলো সহজে ধরা পড়ে না, পড়লেও তার তাৎপর্য বোঝা বা ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। কারণ, ধরে নেওয়া হয় যে সেই সমাবেশ উচ্চবর্গের চৈতন্যের আধার মাত্র, সুতরাং তার নিজস্বতা নেই, আর সেই নিজস্বতার প্রকাশ যে দ্বন্দ্বে ও বৈষম্যে তাও আলোচনার মধ্যে আসে না। নিম্নবর্গের ইতিহাস কিন্তু সেই জমায়েতে রাজনীতির পালটা ও স্বতন্ত্র ধারাটির খোঁজ করবে, আর খোঁজ পেলে-অর্থাৎ তা যদি তথ্যসম্মত হয়—তার মধ্যে নিম্নবর্গের চৈতন্যের অসমতা, স্ত রভেদ, উপাদান-ও-অবস্থাভেদে তার বিভিন্ন প্রকাশ ইত্যাদির বিশ্লেষণ করে সেই বিশেষ জমায়েতটির অনন্যতাকে বর্ণনা করবে। এখানে মনে রাখা উচিত যে জমায়েতের পাত্রস্থানীয় শ্রেণি, গোষ্ঠী বা সমূহের বাস্তব জীবন ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য‍ই এই অনন্যতার একমাত্র কারণ নয়। একই স্থানে একই পাত্রের চৈতন্যে একই সমাবেশের মধ্যে কালভেদে গুণগত পরিবর্তনের অনেক উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে, বস্তুত সব দেশের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর জার্মান কৃষকবিদ্রোহে, ফরাসি বিপ্লবের সমকালীন মহাত্রাসের (লা গ্রাঁদ প্যর) মধ্যে, জার্মান ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব আফ্রিকার মাজি-মাজি অভ্যুত্থানে, আমাদের নিজস্ব নীলবিদ্রোহে, যুক্তপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ১৮৫৭-৫৮ খ্রিষ্টাব্দের কৃষকবিদ্রোহগুলোতে, উত্তরবঙ্গে দেবী সিং-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যে-অর্থাৎ যেখানেই জমায়েতের মেজাজ জঙ্গি ও আয়ুষ্কাল অপেক্ষকৃত দীর্ঘ, সেখানেই চৈতন্যের এই গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়। অন্যত্র আমি এই পরিবর্তনকে ইংরেজিতে ‘সেকেন্ড ওয়েভ' বলে বর্ণনা করেছি। উপমাটা একটু বদলে বাংলায় এর নাম দেব ‘দ্বিতীয় ধাক্কা’, কারণ সত্যিই এই দ্বিতীয় পর্যায়ে সমাবেশের মধ্যে আপসের চেয়ে আঘাতের প্রবণতা হঠাৎ অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে, তিক্ততা ও হিংস্রতা ভীষণ বেড়ে যায়, শ্রেণিসংগ্রামে দীর্ণ হয়ে সমাজ গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই ধাক্কা সামলাতে উচ্চবর্গকে হিমশিম খেতে হয় ।

(৩) একথা যদিও সত্য যে স্থানকালপাত্র ভেদে এক-একটি সমাবেশে তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবুও তাদের মধ্যে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত জঙ্গি জমায়েতগুলোর আকৃতিগত মিল আছে অনেক । গ্রামাঞ্চলে প্রজাবিদ্রোহ, শহরের গরিব জনতার অভ্যুত্থান (যেমন ধরুন, রাওলাট সত্যাগ্রহের সময় দিল্লিতে), গ্রামে ও শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদির মধ্যে আঞ্চলিকতায়, উদ্দেশ্যে এবং সামাজিক পরিচয়ের নানা পার্থক্য সত্ত্বেও দেখা যাবে যে প্রায় একই রকমের কিছু কিছু উপায় ও সংকেতের সাহায্যে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিরা তাদের মিত্রপক্ষকে একত্র করতে ও শত্রুপক্ষকে আঘাত করতে চেষ্টা করেছে সব ক্ষেত্রেই। এই সাদৃশ্যের মূল কারণ উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে প্রভুত্ব ও অধীনতার অতি প্রাচীন সম্পর্ক এবং প্রভুর বিরুদ্ধে অধীনের বহুকালব্যাপী, যদিও ব্যর্থ, প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের চূড়ান্ত, সর্বাঙ্গীণ, সনাতন ও সার্বত্রিক রূপ কৃষকবিদ্রোহ। তারই ঐতিহ্য নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি ধ্রুব উপাদান, এবং ঠিক সেই জন্যেই ঔপনিবেশিক যুগে নিম্নবর্গের সব রকম জঙ্গি জমায়েতেই কৃষকবিদ্রোহের কিছু কিছু লক্ষণ আদর্শে না হোক আকারে দেখা যাবেই। তাই আমার মনে হয় নিম্নবর্গের সমাবেশের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করতে চান, এমনকি যাঁরা গ্রামসমাজের বাইরে অকৃষক জনতার সমাবেশ নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের পক্ষেও কৃষকবিদ্রোহের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
এবার আমার প্রস্তাবটি সম্পর্কে তৃতীয় মন্তব্যে আসি। একথা বলাইবাহুল্য যে নিম্নবর্গের ইতিহাসে তাদের অর্থনৈতিক জীবনকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতি নিয়ে কাজ ইংরেজ রাজত্বের মধ্যেই আরম্ভ হয় ৷ দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে কাজ পরিমাণে যেমন বেড়েছে, গুণেও তেমনি উন্নত হয়েছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস লিখতে হলে এই কাজ থেকে অনেক কিছুই শিখতে হবে। তবে বিষয় নির্বাচন ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে দুটি কথা মনে রাখা দরকার ।
প্রথম কথাটি এই যে ঔপনিবেশিক সমাজের অর্থনৈতিক জীবনে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটি যে বিশিষ্টরূপে প্রকট হয় তা শোষক শোষিতের সম্পর্ক। তাই অর্থনীতির যে-কাঠামোটা আশ্রয় করে সেই সম্পর্ক প্রধানত গড়ে ওঠে—অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা; অর্থনীতিকে সক্রিয় রাখার জন্য আবশ্যক লেনদেনগুলোর মধ্যে যা কিছুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শোষক-শাসিতের সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে; যেমন- মজুরি, খাজনা, ঋণ ইত্যাদি; এই সম্পর্কের অবশ্যম্ভাবী যে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, জমি হারানো, ফসলের ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, আবার অপরপক্ষে শোষকদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে শোষিতের সামান্য একটি অংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে অধিকাংশকেই দরিদ্রতর করে তোলা—এই ধরনের সমস্যাকেই আমার মনে হয় নিম্নবর্গের ইতিহাসে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, এইসব বিষয়ে কাজ করতে গেলেই যে তথ্য আবিষ্কৃত হবে, যে প্রশ্ন উঠবে, সমাধানের জন্য যে নতুন কৌশল ও তত্ত্ব আশ্রয় করে এগোতে হবে, তা থেকে বারবারই একথা পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে শোষক-শোষিতের সম্পর্কটি অর্থনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব-অধীনতার সম্পর্কের বিশিষ্ট প্রয়োগ মাত্ৰ ৷
এই প্রসঙ্গেই আমার দ্বিতীয় কথা-দৃষ্টিভঙ্গির কথাটা এসে পড়ে। ঔপনিবেশিক সমাজে নিম্নবর্গের ইতিহাসে নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলে কিছু নেই। ধনতন্ত্রের পূর্ববর্তী অন্য যে কোনো সমাজের মতো সেখানেও অর্থনীতির অন্তর্গত সব সম্পর্কই আসলে ক্ষমতার সম্পর্ক বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, রাজনীতির সম্পর্ক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। মজুরির হার, খাজনার হার, সুদের হার, সেখানে অবাধ কেনাবেচা চাহিদা- যোগানের নিয়ম মেনে চলে না, চলে শেষপর্যন্ত স্থানীয় সমাজে মালিক জমিদার প্রতিনিধিদের উপরওয়ালা, তাদের সকলেরই পোশাক রাজশক্তির শাসন অনুযায়ী। তাই নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক জীবনের সব বর্ণনার মধ্যেই ক্ষমতার এই সম্পর্কটিকে, অর্থাৎ প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই জন্যেই ঔপনিবেশিক যুগের যন্ত্রশিল্পের ইতিহাস শুধু যদি কলকারখানার বর্ণনা, মজুরি ও মুনাফার হার পরিমাণ, এমনকি লভ্যাংশের বখরা নিয়ে মালিক-মজুরের মধ্যে কড়াগণ্ডার লড়াই বলেই দেখা ও লেখা হয়, তা হলে ক্ষমতার সম্পর্কটি তার মধ্যে হয় ধরা পড়বেই না, বা পড়লেও গৌণভাবে। তাই কারখানার মালিকানার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রভুত্বের সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ও যান্ত্রিক নিয়মের বহির্ভূত শাসনের চাপে উৎপাদন পদ্ধতিকে প্রভাবিত করার জন্য কাজের সময় শ্রমিক ও যন্ত্রের মধ্যে মালিক বা তার প্রতিনিধিদের কর্তৃত্বসূচক হস্তক্ষেপ, কলকারাখানার বিষয়ে সরকারি আইনকানুনের ভূমিকা, কারখানার বাইরে বস্তি, লাইন, চল বা মহল্লায় মালিক মহাজন প্রভৃতির সঙ্গে শ্রমিকের ক্ষমতাবৈষম্যের খেলা, কারখানার জন্য শ্রমশক্তি যোগান দেওয়ার ব্যাপারে সর্দারি প্রথা ও সেই সূত্রে গ্রামসমাজের সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রভাব শহরের শ্রমিক জীবনে-এই সব কিছুই যন্ত্রশিল্পের অর্থনৈতিক দিকগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করতে হবে। তেমনিই আবার বলা যায় যে কৃষকের কত জমি আছে, কত খাজনা বা কর তাকে দিতে হয়, সুদে আসলে তার কাছে মহাজানের কত পাওনা, ফসলের দর ও লাভ-লোকসানের হিসাব— এই সব দিয়েই শুধু অর্থনৈতিক ইতিহাস যদি লেখা হয়, তা হলে তা তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকজীবনের একপেশে বিকৃত বর্ণনায় পর্যবসিত হবে। কারণ কৃষকজীবনের সত্য ওই তথ্যগুলোর মধ্যে বিদ্যমান নয়। প্রভুত্ব ও অধীনতার যে বিশিষ্ট সম্পর্ক ওই সব তথ্যের ধারক তারই মধ্যে কৃষকজীবনের সত্যকে সন্ধান করতে হবে, সেই সত্যের আলোকেই ওই সব তথ্য অর্থময় হয়ে উঠবে। ঔপনিবেশিক ভারতের গ্রামজীবনে সেই সম্পর্কের মূল কথা জমিদার, মহাজন ও সরকার-এই ত্রিশক্তির সঙ্গে কৃষকের ক্ষমতাগত সম্পর্ক। সেই সম্পর্কই অর্থাৎ রাজনীতিই ঔপনিবেশিক আমলের অর্থনীতির প্রধান ধ্রুবগুণ। নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে তাই ব্যাপক অর্থে যা রাজনৈতিক ইতিহাস নামে পরিচিত তারই শাখা বলে ভাবা যায়, যদিও নিঃসন্দেহেই তা সেই জ্ঞানকাণ্ডের একটি প্রৌঢ় ও বহু পল্লবিত শাখা ।
নিম্নবর্গের ইতিহাস বিষয়ক প্রস্তাবটি সম্পর্কে আমার চতুর্থ মন্তব্যে চৈতন্যের দুটি লক্ষণের কথা বলতে চাই। এ যাবৎ আমার সব বক্তব্যের মধ্যে আমি প্রভুত্ব-অধীনতার সম্পর্কটিকে রাজনীতির মর্মস্থলে রেখেছি, বলেছি যে এই সম্পর্কটিই একাধারে রাজনীতির মুখ্য উপাদান ও তার নিয়ন্ত্রক। প্রভুত্ব ও অধীনতা যথাক্রমে সেই সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত বর্গদুটির-অর্থাৎ উচ্চের ও নীচের-চৈতন্যের সাধারণ গুণ। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাই অধীনতার চরিত্রটি পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে প্রভুত্ব ও অধীনতা যেমন দ্ব্যণুক বৈপরীত্যের সূত্রে বাঁধা, অধীনতাও তেমনি একিট দ্ব্যণুক সত্তা যা নিজেই আবার দুটি রাশির বৈপরীত্য দিয়ে গড়া। সেই রাশি দুটি হচ্ছে সহকারিতা ও প্রতিরোধ। নিম্নবর্গের ইতিহাসে দুটি রাশিই সক্রিয়ভাবে উপস্থিত, যদিও অবস্থাভেদে একটি অপরটির চেয়ে জোরদার হয়ে ওঠে এবং অধীনদের চৈতন্যে হয় একটি বা অন্যটি তার প্রাধান্য কায়েম করে সাময়িকভাবে। তাই একথা মনে করা ভুল হবে যে প্রতিরোধই নিম্নবর্গের চৈতন্যের একমাত্র উপাদান। অত্যুক্তি না করেই বলা চলে যে সহকারিতাই প্রতিরোধের চেয়ে সাধারণত বেশি শক্তিমান। তবে একথাও সত্যি যে প্রতিরোধ বিদ্রোহের পর্যায়ে না পৌঁছলেও সহকারিতার পাশাপাশি তার একটি ধারা যতই ক্ষীণ হোক তা সব ঐতিহাসিক অবস্থায়, এমনকি দৈনন্দিন জীবনেও, সবসময়েই বয়ে চলেছে। যেমন অপরপক্ষে বলা যায় যে প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ বিদ্রোহের এমন কোনো নজির ইতিহাসে নেই যার মধ্যে সহকারিতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ।
নিম্নবর্গের চৈতন্যের অপর যে লক্ষণটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে ধর্মভাব । ধর্মভাব বলতে আমি শুধু ধর্মীয় সংস্থার প্রতি আনুগত্য বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি চেতনার সেই ঐতরিক বা ‘এলিয়েনেটেড' অবস্থার কথা যার প্রভাবে জড়জগৎ বা জীবজগতের কোনো সত্তাকে, বাস্তবের বা ভাবনার অন্তর্গত কোনো বিষয়কে তা যথার্থভাবে ধারণার মধ্যে আনতে পারে না, এবং এক বিষয়ের উপর আর এক বিষয়কে তা যথার্থভাবে ধারণার মধ্যে আনতে পারে না, এবং এক বিষয়ের উপর আর এক বিষয়ের গুণ আরোপ করে। ফলে যা ঐহিক তাকে অলৌকিক বলে মনে হয়, যা একান্তই মানবিক তাকে দৈব বলে ভুল হয়। ঐতরিকতার আতিশয্যেই কর্তা কখনও কখনও নিজের সৃষ্টিকেই সঠিকভাবে চিনতে পারে না। যা তার নিজের প্রতিভাজাত তাকে সে অন্যের কৃতিত্ব বলে বর্ণনা করে। তাই মঙ্গলকাব্যের কোনো মহৎ কবির পক্ষে বলা সম্ভব যে তাঁর রচনা তাঁর নিজের নয়, আরাধ্যা দেবী তাঁকে দিয়ে লেখাচ্ছেন: কবি যন্ত্র, দেবী যন্ত্রী। তাই সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিদো ও কানহুর পক্ষে বলা সম্ভব হয় যে ইংরেজ শাসকরা যদি তাঁদের পরোয়ানা শিরোধার্য করে গঙ্গার ওপারে চলে না যায় তা হলে লড়াই বাধবে। কিন্তু তা ইংরেজের সঙ্গে সাঁওতালের লড়াই নয়, ইংরেজের সঙ্গে ঠাকুর লড়াই। অর্থাৎ বিদ্রোহের ঠিক পূর্ব মুহূর্তেও বিদ্রোহী নেতারা তাঁদের যন্ত্রসাধ্য বিশাল কর্মকাণ্ডটিকে নিজেদের সৃষ্টি চিনতে পারছেন না, ঐশ্বরিক বলে কল্পনা করছেন।
এই ধরনের ধর্মভাব নিম্নবর্গের রাজনীতির একটি প্রধান উপাদান। উচ্চবর্গের ইতিহাসবিদ্যায়-ইংরেজ শাসকদের লেখায় বা আমাদের স্বদেশীয়দের মধ্যে অনেক ‘লিবারেল’ ঐতিহাসিকের লেখায়ও-এই চেতনাকে শুধু ধর্মোন্মাদ বলেই দায় সারা হয়, যেন ‘আসল' রাজনীতি বলতে তাঁরা যা বোঝেন তা একেবারেই আলাদা জিনিস অপরপক্ষে, নিম্নবর্গের প্রতি যাঁদের সহানুভূতি আছে তাঁরাও অনেক সময় এই ধর্মচেতনার সাক্ষ্য নিয়ে একটু বিব্রত বোধ করেন এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মধ্যে সেই সাক্ষ্য হয় একেবারেই চেপে যান কিংবা উড়িয়ে দেন এই বলে যে ওটা আসল কথা নয়, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাটাই আসল কথা, এবং সিদো কানহু বিরসা প্রমুখ বিদ্রোহী নেতারা নিজেরা ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, শুধু কুসংস্কারগ্রস্থ কৃষকজনতাকে জমায়েত করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা ধর্মের জিগির তুলেছিলেন। এক কথায়, উভয়পক্ষই 'আসল' রাজনীতি বলতে ধর্মভাবরহিত চৈতন্যের একটি বিশেষ রূপকে বোঝেন ৷
এটা একটা মারাত্মক ভুল এবং এ বিষয়ে সতর্ক না হলে নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখা দুষ্কর। ঐতিহাসিককে মনে রাখতে হবে যে প্রত্যেক দেশেই ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের আগে, জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠার আগে, এমনকি তার পরেও বহুদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের চোখে, বিশেষ করে রাজধানী ও শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গ্রাম ও মফঃস্বলে যারা থাকে তাদের চোখে রাষ্ট্রের সামগ্রিক চেহারাটা সহজে ধরা পড়ে না। তারা রাষ্ট্রশক্তিকে দেখে তার স্থানীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতার গোষ্পদে। আর তাদের ধারণায় রাষ্ট্রের সামগ্রিক ও স্থানীয় রূপের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা থাকে তা তারা ভরে দেয় ক্ষমতার প্রকৃতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে নানারকম অলৌকিক বিশ্বাস দিয়ে। এ জন্যই ক্ষমতার পিরামিডের তলায় যারা একেবারেই মাটির কাছাকাছি সেই নিম্নবর্গের কাছে পিরামিডের শীর্ষস্থ রাজশক্তিকে দেবশক্তি বলে মনে হয়। তাই জারের কাছেই সুবিচার প্রার্থনা করে, এমন কী বিদ্রোহ করে জারের নাম নিয়েই। কারণ যে রাষ্ট্রকে তারা জানে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মারফত, কসাক বাহিনীই তার প্রতিভূ তাদের কাছে, কিন্তু স্বয়ং জার আর একটি, আরও শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রতিভূ। এই দ্বিতীয় রাষ্ট্রের অস্থিত্ব বাস্তবে নয়, কল্পনায়; তাকে যা চালায় তা নাগরিক অধিকার ও দায়িত্বের সংজ্ঞায় সাজানো কোনো সংবিধান নয়, তা নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মচিন্তার দ্বারা। এক কথায় বলা যায় যে সেই রাষ্ট্র একটি অলীক রাষ্ট্র
এই অলীক রাষ্ট্র নিম্নবর্গের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে যে বারবার প্রভাবিত করেছে এ কথা সকলেই জানেন। উদাহরণগুলো সুপরিতি: যেমন, আঠারো শতকে দেবী সিং-এর বিরুদ্ধে উদ্যত সশস্ত্র কৃষকজনতা কোম্পানির দোহাই দিয়েই কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; ঊনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালি ও মারাঠি কৃষক মহারানির নাম করেই মহারানির সাম্রাজ্যের স্থানীয় প্রতিনিধি ও তাদের পোষ্য উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ইত্যাদি। জানা কথা: অলমিতিবিস্তরেণ। শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এই ধরনের দৃষ্টান্তে কোম্পানি ও মহারানি বা একই বিশ্বাসের প্রকারান্তরে লাটসাহেব, রেজিস্ট্রেট সাহেব, জজ সাহেব প্রমুখ ধর্মাবতারের স্থান নিম্নবর্গের চেতনায় দেবদেবীর সঙ্গেই ৷
এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য মনে করি। অলীক রাষ্ট্রবাদের ঐতিহাসিক রূপ সম্পর্কে মার্কস বলেছেন যে এই প্রকার চিন্তা সেই সব শ্রেণিরই চৈতন্যের বৈশিষ্ট্য যারা উঠতির মুখে, যাদের মধ্যে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবিক করার জন্য আবশ্যক উপাদান ও অবস্থা সমাজে তখনও তৈরি হয়নি। সেই বাস্তব ভিত্তির অভাবেই ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে যুক্তিসিদ্ধ ও সুসংগত কোনো ধারণাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠতে পারে না, আর সেজন্যেই তা মগ্ন হয়ে থাকে অলীক রাষ্ট্রবাদের দিবাস্বপ্নে ।
আমি মার্কসের এই কথাটিকে তাঁর অসামান্য চিন্তার মধ্যেও একটি অসামান্য রত্ন বলে মনে করি। অলীক রাষ্ট্রের ধারণাটি যদিও প্রাচীন এবং তার কাল্পনিক আকৃতি পুরাকাল থেকেই বার-বার চিত্রিত হয়েছে সাহিত্যে ও লোকগাথায়, তবু কেবল প্লেটো ও রুশোর কথা বাদ দিলে মার্কসের পূর্বসূরিদের মধ্যে যাঁদের চিন্তা দিয়ে রাষ্ট্রদর্শনের তাত্ত্বিক বনিয়াদ রচিত হয়েছে তাঁরা প্রায় সকলেই শুধু রাষ্ট্রের সুপরিণত ও সর্বাঙ্গে সম্পূর্ণ আদর্শ রূপটি সামনে রেখে তাঁদের বক্তব্য তৈরি করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো সমুদ্রফেন থেকে সদ্যোখিতা আফ্রোদিতির মতো হঠাৎ নিখুঁত ইতিহাস নিরপেক্ষ মূর্তিতে আবির্ভূত হয় না। তার জন্মের ইতিহাস এক-একটি শ্রেণির বা সমূহের সামাজিক সত্তা ও চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই পরিণত রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচয় ছাড়া যেমন কোনো সমাজের রাজনৈতিক চেতনাকে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তেমনি অপরিণত রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে ধারণা অর্থাৎ সেই সমাজে প্রচলিত অলীক রাষ্ট্রবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত না হলে তার রাজনৈতিক ইতিহাসকে সমগ্রভাবে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই জন্যেই টমাস মোর, সাঁ সিম, ফুরিএ, কাবে, ওয়েন প্রভৃতির চিন্তাকে পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণির জন্ম ও বয়ঃপ্রাপ্তির ইতিহাসে উপক্রমণিকার মর্যাদা দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক যুগে ভারতের ইতিহাসেও নানা শ্রেণিসমূহের অপরিণত রাষ্ট্রচিন্তার-অলীক রাষ্ট্রবাদী চিন্তার-নিদর্শন অনেক আছে। অন্যত্র যেমন আমাদের দেশেও তেমনি বিশেষ বিশেষ শ্রেণির বা সমূহের ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা এই চিন্তার মাধ্যমেই ব্যক্ত হয়েছে। সমাজে ও বাস্তব জীবনে সেই আকাঙ্ক্ষাকে সফল করার জন্য আবশ্যক বনিয়াদ তখনও তৈরি হয়নি। ফলে অলীক রাষ্ট্রবাদের মধ্যে ওই সব শ্রেণির বা সমূহের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যেমন সূচিত হয়েছে, তেমনি সূচিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায় ইংরেজ রাজশক্তিকে হঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষমতায় পরিণত করার অক্ষমতা। ওই যুগের উচ্চনীচ উভয়বর্গের অলীক রাষ্ট্রবাদেই আকাঙ্ক্ষা ও অক্ষমতার এই দোটানা বেশ স্পষ্ট। এই জন্যেই উচ্চবর্গের রাজনীতি সম্যক বোঝা সম্ভব নয় বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস, মহাত্মা গান্ধির হিন্দ স্বরাজ-এর সাহায্য ছাড়া। কারণ ভারতীয় উচ্চবর্গের অগ্রণী যে বুর্জোয়াশ্রেণি সর্বশ্বরতা কামনা করেও তা আয়ত্তে আনতে পারেনি, ওই সাহিত্য আসলে তাদেরই সেই ব্যর্থতার সাক্ষী। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। শুধু এ কথাটাই বলে রাখি যে ভারতবর্ষে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের মধ্যে একটা অলীক রাষ্ট্রবাদী উপাদানের অস্তিত্ব আমার কাছে খুবই পরিষ্কার। এই উপাদানটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা না করলে জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আশা করি কোনো কোনো তরুণ ঐতিহাসিক এই জটিল, দ্ব্যর্থময় ও একান্তই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার ক্ষেত্রটি তাঁদের প্রতিভায় উজ্জল করে তুলবেন অদূর ভবিষ্যতে
নিম্নবর্গের চিন্তায়ও অলীক রাষ্ট্রবাদ ওইরকম দোটানায় এবং পরস্পরবিরোধী অর্থের দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। এক দিকে আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বাস্তবে ও চৈতন্যে সেই আকাঙ্ক্ষা সফল করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব ও তজ্জনিত দুর্বলতা। একদিকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, সিদো কানহুর হাতে-গড়া সাঁওতাল ফৌজ, ভারতের নানা স্থানে সারা ঔপনিবেশিক যুগ ধরে হঠাৎ এক একটি জঙ্গি সমাবেশকে উপলক্ষ্য করে কয়েকদিনের জন্য বিদ্রোহীদের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা—এক দিকে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার এই নির্ভীক আত্মঘোষণা ও অপর দিকে ব্যর্থতা, পরাজয়, পলায়ন, হতাশা। আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার ভাবমূর্তি হিসেবে তাই বিদ্রোহীদের অসম্পূর্ণ রাষ্ট্রদর্শন কখনও কখনও তাঁদের পরোয়ানা, জবানবন্দি, গোয়েন্দা পুলিশ বা মিলিটারি রিপোর্টে তাঁদের কথার টুকরো টুকরো উদ্ধৃতি মারফত আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব। তাঁরা নিরক্ষর, কোনো বঙ্কিম ভূদে। গান্ধি তাঁদের হয়ে কলম ধরেননি, সুতরাং তাঁদের বক্তব্য কখনও তাঁদের নিজের ভাষায় শোনা যায় না। কিন্তু তাঁদের শত্রুপক্ষীয় সরকার-সাহুকার- জমিদারদের লেখা নানা বিবরণে ওই রাষ্ট্রচিন্তার রূপটিােক বারে-বারেই বর্ণনা করা হয়েছে, কারণ নিম্নবর্গ যখন ক্ষমতার লড়াই-এ লিপ্ত হয় তখন যারা ক্ষমতাবান তাদের শুনতে হয় নিম্নবর্গ কী বলতে চাইছে, তা লিখে রাখতে হয় সরকারি বেসরকারি কাগজপত্রে ।
এই সব সাক্ষ্য থেকে এ কথাটা বেশ পরিষ্কার হয় ওঠে যে নিম্নবর্গের আকাঙ্ক্ষা ও অসাধ্যতার এই দ্বন্দ্বই তাঁদের চিন্তায় ধর্মভাবকে কায়েম করে রেখেছে। তাই সাঁওতাল হুলের একটি বিখ্যাত যুদ্ধের মধ্যেই সিদো কানহু পূজায় বসেন এবং বন্দুকের টোটা ঠাকুরের দয়ায় গলে জল হয়ে যাবে এই বিশ্বাসের ফলে তাঁদের পরাজয় ঘটে। এইভাবেই অলীক রাষ্ট্রবাদের যে দিকটা আকাঙ্ক্ষার তা নিম্নবর্গকে উৎসাহিত করেছে তার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ও মৌলিকতা নিয়ে জমায়েত হতে, আর যে দিকটা অসাধ্যতার তা তাকে বাধ্য করেছে দৈব ও পারলৌকিকতার আশ্রয় নিতে। নিম্নবর্গের চৈতন্যকে যখন আমরা ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উদ্যোগী হব তখন যেন তার এই ধর্মাশ্রয়ী দোটানা চরিত্রের গুরুত্ব ও জটিলতা স্বীকৃতি পায় আমাদের গবেষণায়, আমাদের রচনায় ।
[সূত্র: Sabultern Studies, Ranajit Guahal
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থার সার্বিক বিশ্লেষণ
প্রাচীনকাল থেকেই গোটা বাংলা ছিল একটি কৃষিনির্ভর সমাজ। এ সমাজের প্রাণ ছিল নিম্নবর্গের প্রজাসাধারণ। এক সময়ে বিশ্ববাজারে সমাদৃত বাংলায় উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী ছিল বস্তুত কৃষিভিত্তিক গ্রামবাংলার অবদান। এমনকি, উৎপাদন ও মানব বসতির দিক থেকে বাংলাদেশ আজও একটি কৃষিনির্ভর দেশ। কিন্তু বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী উৎপাদন ব্যবস্থা আর নেই। প্রাচীনকালে, এমনকি মধ্যযুগেও কৃষক শ্রেণি ও শাসকশ্রেণিকে পৃথক করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না। এমন কোনো শক্তিশালী শহুরে শ্রেণিও তখন ছিল না যাদের সামাজিক অবস্থান দ্বারা জনগণকে গ্রামীণ ও শহুরে এবং ধনী ও দরিদ্র হিসেবে শ্রেণিবিভক্ত করা যেত।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্তারা এ কৃষক শ্রেণিকে সাবার্ডিনেট (নিম্নবর্গ) বলেছেন। ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানিদের মতে তখন জনসাধারণ স্বনির্ভর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে বসবাস করতো, যদিও তারা সেকালে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্যমান সমাজের অনুরূপ স্বশাসিত সমাজের অস্তিত্ব বাংলায় ছিল বলে স্বীকার করেন না। ধারণা করা হয় যে, বাংলার পল্লিসমাজ তখন এই বিশাল বদ্বীপের সমতলভূমি জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ বসতিতে বিন্যস্ত ছিল। স্বনির্ভর গ্রাম বিদ্যমান থাকার কারণে জনসাধারণের ব্যক্তিক ও সামাজিক গতিশীলতা ছিল অত্যন্ত সীমিত ।
বাংলার জনগণ অর্থনৈতিক দিকে সুস্পষ্টভাবে শ্রেণিবিভক্ত না হলেও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ছিল ভিন্নতর। পেশাগত বিভাজন তথা বর্ণপ্রথা ভিত্তিক সমাজবিন্যাসে তারা বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত ছিল এবং এই অবস্থা তাদের সমাজব্যবস্থাকে দৃঢ় করেছিল। পল্লিসমাজের মানুষ নির্দ্বিধায় রাজার প্রাপ্য পরিশোধ করতো, কেননা রাজপ্রাপ্য ছিল ধর্মানুমোদিত। ধর্মশাস্ত্রে নির্ধারিত ছিল রাজকরের পরিমাণ এবং রাজপ্রতিনিধিরা তা আদায় করতো। রাজপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ প্রকাশের তেমন কোনো অবকাশ না থাকায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে কোনো কৃষক আন্দোলন ছিল না অথবা খুবই বিরল ছিল ।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলায় নিম্নবর্গ কৃষক সমাজের ভিন্নতর চিত্র পাওয়া যায়। এই শাসনের গোড়া থেকেই রায়তরা তাদের স্বার্থবিরোধী সরকারি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব এজেন্ট কর্তৃক উচ্চহারে খাজনা আদায় ও বিবিধ শোষণের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ১৭৬৮-১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মহামন্বন্তর থেকে শুরু করে দুর্ভিক্ষ ও অনটন এদশে একটি স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। এমতাবস্থায় কৃষকদের মধ্যে বিক্ষোভ ঘনীভূত হতে থাকে। কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফকির ও সন্ন্যাসীরা। দেশে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব না থাকায় এবং ঐতিহ্যবাহী অভিজাতবর্গ পর্যুদস্ত হওয়ায় সমকালীন সমাজকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে সমাসীন ধর্মীয় নেতারা নতুন শাসকগোষ্ঠীর উচ্চহারে খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের পক্ষে দাঁড়াবার প্রয়োজন অনুভব করেন। তারা বিদেশী শাসকগোষ্ঠীকে সদাশয় শাসকের পরিবর্তে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বলেই মনে করতেন। মজনু শাহ ছিলেন প্রথম ধর্মীয় নেতা যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁর কৃষক অনুসারীরা আঠারো শতকের সত্তর থেকে আশির দশক পর্যন্ত উত্তর বাংলার বিভিন্ন অংশ এবং ময়মনসিংহ ও ঢাকায় প্রতিরোধ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল। ফকির সন্ন্যাসী পরিচালিত প্রতিরোধের ব্যর্থতা অবশ্য নিম্নবর্গ কৃষক আন্দোলনের চূড়ান্ত পতন ঘটায়নি। বাকেরগঞ্জের বালাকি শাহ, সিলেটের সৈয়দ আগা মুহাম্মদ রেজা বেগ ও কুমিল্লার কালু শাহ প্রমুখ ধর্মীয় নেতা কৃষকদের স্বার্থে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জের কৃষকগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে তাদের পরগনা থেকে অত্যাচারী জমিদারদের বিতাড়িত করে এবং সবাইকে ‘পরগনা নিরিখ' অনুযায়ী খাজনা আদায়ের নির্দেশ দেয়। বালাকি শাহ নির্দেশ জারি করেন যে, যেসব জমিদার রায়তদের নিকট
থেকে পরগনা নিরিখের অতিরিক্ত খাজনা আদায় করেছে, তাদের অতিরিক্ত খাজনা ফেরত দিতে হবে। তিনি জনৈক শাহ জিয়ানকে কয়েকটি পরগনার অধিপতি ঘোষণা করেন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বালাকি শাহ ও শাহ জিয়ানকে সামরিক শক্তিবলে দমন করা হয়। সিলেটের জনৈক ধর্মীয় নেতা ও অভিজাত সৈয়দ আগা মুহাম্মদ রেজা বেগ ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কৃষক এবং ইংরেজবিরোধী ভূস্বামীদের সমর্থন নিয়ে কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয় এবং কয়েকটি যুদ্ধের পর তাঁকে বন্দি করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় ।
আঠারো শতকের অধিকাংশ নিম্নবর্গ কৃষক বিদ্রোহ ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হলেও এগুলো পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল না । এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের রংপুর কৃষক বিদ্রোহ রাজস্ব আদায়কারী দেবীসিংহের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রংপুর জেলার চাষিরা ক্ষুদ্র ভূস্বামী ধীরাজ নারায়ণের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এবং কাজীর হাটে অবস্থিত দেবীসিংহের সদরদপ্তর দখল করে নেয়। রায়তরা তাদের নেতাকে নবাব ঘোষণা করে। সরকার প্রথমত বিদ্রোহটি নির্মমভাবে দমন করে এবং অতঃপর দেবীসিংহের সঙ্গে সম্পদিত চুক্তি বাতিল ও তার অধীনস্থ সকল পরগনায় খাজনা হ্রাস করে বিদ্রোহীদের শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা চাষিরা আরেকটি অত্যন্ত সফল প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করে। কোম্পানি সরকার কর্তৃক পার্বত্য এলাকায় জুম চাষিদের কাছ থেকে নগদ খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে চাকমা রাজা ব্রিটিশ শাসন প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং কোম্পানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ি সমাজের স্বশাসিত মর্যাদা স্বীকার করে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়া পর্যন্ত এই গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহত ছিল।
আঠারো শতকের শেষার্ধে ভূমি বন্দোবস্ত ও খাজনা আদায় ব্যবস্থার ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সরকারের অধিক ভূমিরাজস্ব সংগ্রহের প্রচেষ্টার কারণে বাংলার নিম্নবর্গ কৃষককুল চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হয় এবং এর ফলে কৃষি-অর্থনীতিতে ধস নামে, দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাবলির ফলে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক অস্থিরতা ও গোলযোগ অনিবার্য ছিল। ঊনিশ শতকেও অনুরূপ বিদ্রোহ দেখা গেছে, কিন্তু সেগুলোর প্রকৃতি, ব্যাপ্তি ও সংগঠন বস্তুত পূর্ববর্তী শতকের বিদ্রোহগুলো থেকে ভিন্নতর ছিল ।
বাংলার নিম্নবর্গ কৃষককুল ঊনিশ শতকে জমিদারদের অধীনস্থ প্রজায় পরিণত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার সুবাদে জমিদারগণ হন জমির নিরঙ্কুশ মালিক এবং রায়তরা তাদের প্রজা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের আওতায় জমির নিরঙ্কুশ মালিক জমিদাররা খাজনা বৃদ্ধি, জমির যথেচ্ছা ব্যবহার এবং অবাধ্য প্রজা উচ্ছেদের ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু রায়তরা তাদের এই অবস্থান স্বীকার করতে চায়নি। তারা জমিতে তাদের অধিকার দাবি করে। তাদের যুক্তি ছিল, জমিতে তাদের চিরাচরিত অধিকার ক্ষুণ্ণ করে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। অধিকন্তু যতদিন তারা ‘জমা' (ভূমিরাজস্ব) পরিশোধ করবে, শান্তিপূর্ণভাবে জমি চাষ করবে, ততদিন কেউ তাদের জমি থেকে উচ্ছদ করতে পারে না এবং কেউ পরগনা নিরিখ বা পরগনার নির্ধারিত হারের অধিক খাজনাও ধার্য করতে পারে না ।

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর দরিদ্র সাধারণ কিংবা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থা ১০১
জমির উপর প্রজাদের অধিকার ও ভূমিরাজস্ব নিয়ে জমিদার ও রায়তদের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রায়শ জমিদারগণ সরকারি সহায়তার বলপ্রয়োগে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতো এবং রায়তদের খাজনাসহ অন্যান্য আবওয়াব পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। তবে তারা রায়তদের প্রতিরোধের সম্মুখীনও হচ্ছিল। উনিশ শতকের প্রথম দিকের দুটি স্মরণীয় নিম্নবর্গ কৃষক বিদ্রোহ হচ্ছে শেরপুর বিদ্রোহ (১৮২৪-১৮৩৩) ও তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩৩)। শেরপুর কৃষক বিদ্রোহ সাধারণভাবে পাগল বিদ্রোহ নামে পরিচিত, কারণ এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেরপুর খানকা থেকে ফকির-দরবেশগণ। এ খানকার প্রধান টিপুশাহ ছিলেন বিদ্রোহের মূল সংগঠক। পরগনা নিরিখ লঙ্ঘন করে স্থানীয় জমিদারগণ কর্তৃক কয়েকবার খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে শেরপুরের আদিবাসী বাঙালি কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং পরগনা থেকে জমিদারদের বিতাড়িত করে। রায়তরা পরগনাগুলোর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং সরকারের উদ্যোগে একটা সমঝোতায় পৌছার পূর্ব পর্যন্ত নয় বছর তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখে। প্রতিরোধের এক দশকে বহু সংঘর্ষ ঘটে এবং বহু লোক প্রাণ হারায়। একইভাবে বারাসত জেলার রায়তরাও অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এখানেও বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ধর্মীয় নেতা তিতুমীর ।
শেরপুর ও বারাসত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে প্রধানত ধর্মীয় নেতৃত্বে পরিচালিত নিম্নবর্গ কৃষক প্রতিরোধের একটি পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। পশ্চিমা শিক্ষব্যবস্থার প্রসার, সংবাদপত্র ও জনমতের বিকাশ, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ সহ বাজার নিয়ন্ত্রণ শক্তির অগ্রগতি, জনগণের দাবির প্রতি ইঙ্গ-ভারতীয় উদারপন্থি ও মিশনারিদের সমর্থন এবং ব্রিটিশরাজ কর্তৃক শাসনভার গ্রহণ কার্যত সরকার ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জনগণের ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। এ পর্যায়ে নিপীড়িত কৃষকরা নিজেরাই সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ঊনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে নীল প্রতিরোধ আন্দোলন ও সাঁওতাল বিদ্রোহ ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবর্গ কৃষকদের দ্বারাই সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছে। কলকাতার অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র বিদ্রোহী চাষিদের পক্ষ সমর্থন করেছিল। ফরায়েজি কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুদু মিয়া । তিনি একজন ধর্মীয় নেতা হলেও তাঁর নেতৃত্ব মজনু শাহ, বালাকি শাহ, টিপু শাহ ও অন্যান্যের মতো ছিল না। নিপীড়ক জমিদারদের বিরুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ সংগ্রামকে জোরদার করার জন্যই তিনি আন্দোলনে ধর্মীয় উদ্দীপনা প্রয়োগ করেছিলেন ।
ঊনিশ শতকের সত্তরের দশক ও পরবর্তীকালের নিম্নবর্গ কৃষক আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো ও কর্মতৎপরতায় আধুনিকতার ছাপ লক্ষণীয়। পাবনার চাষিরা জমিদার কর্তৃক বলপূর্বক খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং তাদের অধিকারের দাবিতে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জোট বা মোর্চা গঠন করে ‘খাজনাবন্দ' ধর্মঘট আহ্বান করে এবং জমিদারগণ তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। অনুরূপভাবে বাকেরগঞ্জের তুষখালি (১৮৭২-৭৫), ফেনীর ছাগলনাইয়া (১৮৭৪) ও মুন্সিগঞ্জের (১৮৮০-৮১) কৃষক আন্দোলনে কৃষকরা অভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। কৃষকদের এধরনের অব্যাহত
আন্দোলন এবং তাদের সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তন ঔপনিবেশিক সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। সরকার উপলব্ধি করে যে, কৃষকদের দাবিদাওয়া পূরণ না করলে অচিরেই সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেবে এবং তা খোদ সরকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ফলত সরকার ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলার প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে এবং রায়তদের অধিকার অনেকাংশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।
ঊনিশ শতকের ঘটনাবলি বাংলার নিম্নবর্গ কৃষকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটায়। শহরভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কৃষক-শাখা অতঃপর কৃষকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলন শুরু করে। নির্বাচনের রাজনীতিতে কৃষকরা তাদের নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণেও একটি নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে। ভারত বিভাগের আগে কৃষক আন্দোলনগুলোতে স্বভাবতই সম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। কিশোরগঞ্জ (১৯৩২) ও অন্যান্য স্থানে কৃষক আন্দোলনে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গের অব্যবহিত পূর্বে তেভাগা, নানকার, টঙ্ক প্রভৃতি সকল আন্দোলনই ছিল বহিরাগত ভাবধারায় প্রভাবিত। এ পর্যায়ে বামপন্থি নেতৃত্বের দ্বারা কৃষকদের আদর্শ ও রণকৌশল নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগ এবং ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বাংলার জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর কৃষক আন্দোলনের আরও চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে। ভূমিসংস্কার ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ এবং গ্রামীণ সমাজের রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে কৃষকদের অভাব অভিযোগ প্রশমনের রাষ্ট্রীয় নীতি কৃষক আন্দোলনের চিরায়ত রূপকে একটি অতীত ঘটনায় পর্যবসিত করেছে ।
উপর্যুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার দরিদ্র সাধারণ তথা নিম্নবর্গের সাধারণ অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
কে নিম্নবর্গ গবেষণার পথিকৃৎ
উত্তর : রণজিৎ গুহ ।
প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলার কোন বিষয়ে গবেষণা সবচেয়ে কম? উত্তর : নিম্নবর্গের আর্থসামাজিক ও বিকাশধারা বিষয়ে ।
কোন ইতিহাসের উপাদান-উপকরণের অপর্যাপ্ততা রয়েছে?
উত্তর : নিম্নবর্গের ।
৪. বিখ্যাত ব্রিটিশ সামাজিক ঐতিহাসিক কে?
উত্তর : জর্জ মেকলে ট্রেভেলিয়ান ।
৫. জর্জ মেকলে ট্রেভেলিয়ান এর গ্রন্থের নাম কী?
উত্তর : English Social History.

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]