কালবিভাজনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : মানব সভ্যতার উত্থান ও পতনের সময়কাল গণনা ও যথার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস সামনের দিকে এগিয়ে চলে। কালক্রম ইতিহাসের বর্ণনাকে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ করে তোলে। সাধারণত মানব সভ্যতার জীবনপ্রণালির সাথে ওতোপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট ধর্ম বা বিশ্বাস, আর্থসামাজিক বড় কোনো পরিবর্তন, বিভিন্ন ধরনের মতবাদকেন্দ্রিক বিশেষ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টির সময়কালকে মাপকাঠি ধরে ইতিহাসের কালক্রম নির্ধারিত হয়ে থাকে ।
" ইতিহাসের কালবিভাজনের প্রেক্ষাপট : মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ পর্যন্ত বহু ধরনের কালক্রম ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কয়েকটি কালক্রম হলো— ১. খ্রিস্টান কালক্রম, ২. হিজরি কালক্রম ও ৩. বাংলা কালক্ৰম । নিম্নে এসব কালক্রমের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. খ্রিস্টান কালক্রম : বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কালক্রমগুলোর মধ্যে খ্রিস্টান কালক্রম অন্যতম। মূলত যিশু খ্রিস্টের জন্মকে একটি বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে পণ্ডিতগণ খ্রিস্টান কালক্রমের অবতারণা করেন। এ বর্ষপঞ্জিকে গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি, পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জি প্রভৃতি নামে ডাকা হয় । ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগোরির এক আদেশানুসারে এ কালক্রমে প্রচলন ঘটে। সেই সময়ে মুষ্টিমেয় দেশ এ বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করলেও বর্তমানে প্রায় সব দেশই গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জিতে সময়কাল ক্রমের হিসাবনিকাশ করে থাকে । বর্তমান খ্রিস্টান অব্দের সাথে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছেন খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক হযরত ঈসা (আ.)। উল্লেখ্য মুসলমানদের কাছে তিনি ঈসা নবি নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। ইংরেজিতে বলা হয় Jesus Christ. বাংলা খ্রিস্টাব্দে গৃহীত হয়েছে ইংরেজি Christ থেকে । সাধারণভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে যে, খ্রিস্টের জন্মগ্রহণের বছর থেকেই এ অব্দের গণনা শরু হয়েছে। যদিও বলা হয় ১ জানুয়ারি কিংবা ১ খ্রিস্টাব্দেই যিশু জন্মেছিলেন তবে একথা সর্বাংশে সত্য নয়। মূলত বর্তমানে খ্রিস্টাব্দ হলো যিশু খ্রিস্টের স্মরণে ব্যবহৃত একটি প্রতীকী অব্দ । প্রাচীন মিসরীয়রা সর্বপ্রথম এ অব্দের ব্যবহার করেছিল। খ্রিস্টাব্দ হিসাবনিকাশে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় । যার একটি AD এবং অন্যটি BC। এর মধ্যে AD কে Anno Domini বাংলাতে খ্রিস্টাব্দ এবং BC কে Before Christ বাংলাতে খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলা হয় । আর এভাবে যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগেকার এবং পরের সময়কাল যথার্থভাবে নির্ণয় করে গণনা করা হয় । ২. হিজরি কালক্রম : হিজরি বর্ষপঞ্জি মুসলমানদের নিকট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত বলে একে ইসলামি বর্ষপঞ্জিও বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশ চন্দ্রনির্ভর এ হিসাব অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করে থাকে। মূলত ইসলাম ধর্মের শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কার কুরাইশ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে মক্কা থেকে মদিনা চলে যান। তার এ জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে ইসলামে হিজরত বলে আখ্যা দেওয়া হয় । রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই হিজরি সাল গণনার সূচনা হয় । হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন হযরত ওমর (রা.)। তিনি রাসুল (সা.) এর মৃত্যুর সাত বছর পর চন্দ্র মাসের হিসাবে এ পঞ্জিকার প্রবর্তন করেন। হিজরতের এ ঐতিহাসিক তাৎপর্যের ফলেই হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র পঞ্জিকা প্রণয়নের কথা বলা হয় তখন তারা সর্বসম্মতভাবে হিজরত থেকেই পঞ্জিকার গণনা শুরু করেন। যার ফলে চন্দ্রমাসের পঞ্জিকাকে বলা হয় হিজরি সন।
৩. বাংলা কালক্রম : ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বাংলা কালক্রমের প্রবর্তন করেন। এ নতুন বর্ষপঞ্জি প্রথমে তারিখ ই এলাহী নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। নতুন এ সালটি আকবরের রাজত্বের উনিশতম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে, কারণ এদিন আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ কালক্রম প্রবর্তনের পিছনে আকবরের উদ্দেশ্য ছিল তার রাজ্য বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখা এবং আরও পদ্ধতিগত ভাবে রাজস্ব আদায় করা । আকবরের সভাকবি আবুল ফজল 'আকবরনামা' গ্রন্থে বলেছেন যে, হিজরি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার ছিল কৃষক শ্রেণির জন্য একটি সমস্যার ব্যাপার। কারণ চন্দ্র ও সৌরবর্ষের হিসাবে কিছুটা গড়মিল ছিল এবং এ কারণে ৩১ চন্দ্রবর্ষ ৩০ সৌরবর্ষের সমান ছিল। সে সময় চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা হতো। কিন্তু ফসল সংগ্রহ করা হতো সৌরবর্ষ অনুযায়ী। আকবর তার রাজত্বের শুরু থেকেই দিন গণনার জন্য একটি একক কালক্রমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জ্যোর্তিবিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে প্রচলিত বর্ষপঞ্জিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের দায়িত্ব প্রদান করেন। তার প্রচেষ্টায় বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। যা বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তবে চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস ধরা হয়। আর এভাবেই বাংলা কালক্রমের গণনা শুরু হয় ।
এছাড়া আরও কয়েকটি ছোট ছোট কালক্রমের কথাও জানা যায় । এগুলো হলো—
ক. গুপ্তাব্দ : গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ৩২০ খ্রিস্টাব্দে প্রচলন করেন ।
খ. শকাব্দ : শকাব্দের প্রচলন ঘটে সম্ভবত ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট কনিষ্ক তার সিংহাসন আরোহণ কালকে স্মরণীয় করতে সম্ভবত শকাব্দের প্রচলন করেন ।
গ. গ্রিক কালক্রম : প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিক খেলা খুবই জনপ্রিয় একটি আসর ছিল। অলিম্পিক সর্বপ্রথম ৭৭৩ অব্দে শুরু হয়। এ খেলার আসর প্রতি চার বছর পর পর বসত। আর এজন্য গ্রিসবাসীরা অলিম্পিককে মানদণ্ড ধরে ১ম অলিম্পিক বর্ষ, ২য় অলিম্পিক বর্ষ, ৩য় অলিম্পিক বর্ষ এভাবে সময়কালের হিসাব প্রবর্তন করেন ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কালক্রম ইতিহাসের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কালক্রমের মাধ্যমে ইতিহাস পাঠ আরও সুনির্দিষ্ট ও সহজবোধ্য করে তোলা হয়েছে। ফলে প্রত্যেকটি জাতি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে পারছে। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব, সমাজ ও সভ্যতার ধারণা বিকশিত হওয়া থেকে আজ অবধি বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ইতিহাসের কালবিভাজন সময়ের দাবি ছিল। ইতিহাসের এ কালবিভাজন ঐতিহাসিকগণকে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন মানব সভ্যতার ক্রমিক পরিবর্তন প্রভৃতি বুঝাতে সক্ষম হয় । যার কারণে কালবিভাজন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]