উত্তর ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিক যুগের অপর নাম দেওয়া হয়েছে প্রস্তর যুগ বা পাথরের যুগ। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, মানুষ এসময়ে বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে পাথর সংগ্রহ করা, পাথর ভাঙা, পাথর কাটা এবং ঘষেমেজে পাথরকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে । এ কারণে একে প্রস্তর যুগ বা পাথর যুগ নামে অভিহিত করা হয়। প্রস্তরযুগে মানবসমাজ খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তে খাদ্য শিকারের পিছনে সময় ব্যয় করতো। অর্থাৎ এসময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী। এ যুগে মানুষ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ গঠন, সাম্যবাদী সমাজ গঠন, পোশাক-পরিচ্ছদ, আগুনের ব্যবহার, কথা বলার সক্ষমতা অর্জন, চিত্র অঙ্কন প্রভৃতি গুণাবলি অর্জন করে ।
● প্রস্তরযুগে মানব সভ্যতার অগ্রগতি : প্রাগৈতিহাসিক যুগ ছিল মানব সভ্যতার দক্ষতা বা গুণাবলি অর্জনের প্রথম ধাপ । এ সময়কালে মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত অর্জন ছিল খুবই কম। তবে একথা বলা যায় যে, বর্তমানে যতটুকু দক্ষতা বা গুণাবলি মানুষ অর্জন করেছে তার সূচনাকাল নিহিত আছে সেই প্রাগৈতিহাসিক তথা প্রস্তরযুগেই ।
নিম্নে প্রস্তরযুগে মানব সভ্যতা অগ্রগতির বিভিন্ন দিকসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. হাতিয়ার তৈরি : পাথর দ্বারা বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ছিল প্রস্তর যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পাথরের তৈরি বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র এ যুগের মানুষের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন ছিল। প্রস্তরযুগে মানুষ তার চারপাশের পাথর ভেঙে তা ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র ও হাতিয়ার বলতে ছিল একটি বড় পাথরকে ভেঙে কোনোরকম ব্যবহার উপযোগী করা অর্থাৎ বিরাট পাথর ভেঙে শিকারকে আঘাত করার মতো হাতিয়ার বানানো। যা এসময়ের সভ্যতার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল। এসময়ে মানুষ কাঠ বা পাথর ছিদ্র করার জন্য ড্রিল মেশিন সদৃশ যন্ত্র আবিষ্কার করে। প্রস্তর যুগের শেষ সময়টিকে নব্য প্রস্তর যুগ বলে অভিহিত করা হয়। কারণ এসময়ে মানুষ আগের চেয়ে আরও উন্নত, মসৃণ, সূক্ষ্ম অস্ত্র তৈরি করে নিজেদের শিকার করার কৌশলকে উন্নত করে তোলে ।
২. শিকার করার পদ্ধতি অর্জন : প্রস্তর যুগের প্রথমদিকে মানুষ ছোট ছোট পশু শিকার করলেও হাতিয়ারের ক্রমোন্নতির ফলে এ যুগের মাঝামাঝি পর্যায় থেকে মানুষ বড় বড় পশু শিকার করার পদ্ধতি আয়ত্ত করে। পাথরের অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি তারা ফাঁদের সাহায্যে বলগা হরিণ, বাইসন, হাতি প্রভৃতি প্রাণী শিকার করার কৌশল শিখে
ফেলে। তারা বড় পশুকে তাড়া করে এনে জলাভূমিতে ফেলে অথবা পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে বা গর্তে ফেলে শিকার করতো। তাছাড়া অনেক সময় তারা বড় বড় গর্ত করে গর্তের মধ্যে কাঠের শূল পুঁতে রাখত এবং গর্তের মুখে হালকাভাবে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে গর্তটি পশুর চোখের আড়াল করে রাখত। বন্যপশু ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় শিকারে আটকা পড়ত। প্রস্তর যুগের মানুষরা গায়ে গোবর মেখে শিকারের আশায় বনজঙ্গলে অপেক্ষায় থাকত। এভাবে প্রস্তর যুগের মানুষ পশু শিকারের কতিপয় নিয়মকানুন আবিষ্কার করে ।
৩. বাসস্থান নির্মাণ : প্রস্তর যুগের প্রথমদিকে মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করতো। মানুষ শুধু খাদ্য শিকারনির্ভর জীবনযাপন করতো। কিন্তু প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ কৃষির প্রচলন করে । ফলে ধীরে ধীরে কৃষি মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে শুরু করে। ফলে মানুষ জলাশয়ের ধারে স্থায়ীভাবে বাসস্থান গড়ে তুলতে শুরু করে । এসময়ে মানুষ বাঁশ, বেত, কাঠ ও মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করার পদ্ধতি শেখে। তাছাড়া কাঠ বা বাঁশের খুঁটির ওপর তক্তা · বিছিয়ে বন্য হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জলাশয়ের মাঝখানে মাটি ফেলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সেখানে ঘর নির্মাণ করার পদ্ধতি শেখে ।
৪. গৃহে পশুপালনের সূচনা : প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথমে মানুষ পশু শিকার করে দৈনন্দিন খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতো। কিন্তু প্রস্তরযুগে মানুষ বন থেকে ধরে আনা কিছু দুর্বল পশুপালন করার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পোষ মানাতে শুরু করে। এভাবে তারা গরু, গাধা, হরিণ, প্রভৃতি পশু বশে এনে পালন করতে থাকে। মানুষ বুঝতে শেখে যে এসব প্রাণী হত্যা করে খেয়ে ফেলার চেয়ে পোষ মানানো লাভজনক । যদিও বন্যপশুকে পোষ মানানোর কৌশল রপ্ত করতে মানুষের অনেক সময় লেগেছে ।
৫. আগুনের ব্যবহার আয়ত্তকরণ : সভ্যতার ক্রমবিকাশে নিরব বিপ্লবের জন্ম দেয় আগুন। যে মনুষ্য জাতি প্রাগৈতিহাসিক যুগের শুরুতে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি জানত না তারাই আবার এ যুগের শেষদিকে আগুন জ্বালিয়ে তা ব্যবহার করার পদ্ধতিও আয়ত্ত করে ফেলে। প্রাকৃতিক ঘটনা দেখে মানুষ আগুনের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পায়। নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ আগুনের বহুমুখী ব্যবহার, আগুন দীর্ঘক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা, যেকোনো সময় আগুন জ্বালানো প্রভৃতি আয়ত্ত করে ।
৬. কুমারের চাকা আবিষ্কার : কুমারের চাকা আবিষ্কার প্রস্তর যুগের অপর একটি বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ। মানুষ প্রথমে মাটির পাত্র বানানোর কৌশল আয়ত্ত করে মাটির পাত্র মসৃণ করার জন্য ক্রমাগত হাত ঘোরাতে হতো। তাই হাত ঘুরানোর প্রয়োজনে প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মেয়েরা কুমারের চাকা আবিষ্কার করে। চাকা আবিষ্কার হওয়ার পর একজন ভালো মৃৎশিল্পীর পক্ষে অল্প সময়ে অনেকগুলো পাত্র তৈরি করা সম্ভবপর হয়।
৭. সামাজিক বন্ধন : প্রস্তরযুগে মানুষ যখন স্থায়ী ঠিকানায় বসবাস করতে থাকে তখন সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও বংশ রক্ষা করার জন্য বিবাহশাদির সূচনা করে। তারা দুই প্রকার বিবাহের সূচনা করে, যথা : একগামিতা ও বহুগামিতা। এ যুগে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী ছিল। একজনের একাধিক স্ত্রী থাকার কারণে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে । তাছাড়া এ যুগে গুহা, মাটির গর্ত, গাছের ডাল দ্বারা তৈরি প্রভৃতি বাসস্থান পরিত্যাগ করে মানুষ সমতল ভূমিতে ঘর বানিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতে থাকে।'
৮. পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা : নবোপলীয় যুগের অর্থনীতি মূলত দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এর একটি কৃষি ও অন্যটি পশুপালন। প্রস্তর যুগের ক্রমাগত হাতিয়ারের উন্নতির সাথে মানুষ কৃষির ব্যবহার শুরু করলে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা ঘটে। পশুপালনের ফলেও মানুষ পশুর চামড়া, মাংস ও লোমকে পণ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তা ক্রয়-বিক্রয়ের সূত্রপাত ঘটায়। আর এ সবকিছুর ওপর ভিত্তি করে প্রস্তর যুগের মানব সভ্যতা দ্রুত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ বা অগ্রগতি একদিনে সংঘটিত হয়নি। প্রস্তর যুগ ছিল মানব সভ্যতার অগ্রগতির প্রথম পর্যায়। এ পর্যায়ে মানুষ শিকারে নতুন হাতিয়ার ব্যবহার, সামাজিক বন্ধন রচনা, পশুপালনের সূচনা, কৃষির প্রচলন, ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা প্রভৃতির মাধ্যমে উৎকর্ষ অর্জন করে। এ উৎকর্যের হাত ধরেই মানব সভ্যতা আধুনিক, উত্তরাধুনিক যুগের পর্যায়ে উপনীত হয় । মানব সভ্যতা বিকাশে তাই এ যুগের অবদান অপরিসীম ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত