প্রাচীন প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ লেখ।

উত্তর ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথমদিকের সময়কাল পুরোপলীয় যুগ বা পুরাতন প্রস্তর যুগ নামে পরিচিত। প্রাগৈতিহাসিক যুগের তিনটি ভাগের মধ্যে পুরোপলীয় যুগের সময়কালই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ স্থায়ী। এ যুগে মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, জীবাশ্ম প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে নৃবিজ্ঞানীরা এর সময়কাল পঞ্চাশ হাজার বছর থেকে শুরু
করে পনেরো হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল বলে গণ্য করেন। পুরোপলীয় যুগে পাথরের যেসব অস্ত্রশস্ত্র ও দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হতো সেগুলো ছিল স্থূল, অমসৃণ ও অমার্জিত। পুরোপলীয় যুগে মানবদেহের গঠনপ্রকৃতি, সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, শিকার করার পদ্ধতি আবিষ্কার, আবাসস্থল ও পোশাক-পরিচ্ছদ, আগুনের ব্যবহার আয়ত্তকরণ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট স্থান দখল করে।
পুরোপলীয় যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে পুরোপলীয় যুগে মানবসমাজের অগ্রগতি বা পুরোপলীয় যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. মানবদেহের গঠনপ্রকৃতি ও ক্রমপরিবর্তন : প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণ মোতাবেক প্রায় চার/পাঁচ কোটি বছর পূর্বে এক প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণী গাছে বাস করতো। যারা ইতিহাসে প্রাইমেট নামে পরিচিত। বিভিন্ন জীবাশ্মের ওপর দীর্ঘকাল গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবেত্তাগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, আদিকালের প্রাইমেটদের একটি শাখা লক্ষাধিক বছর ধরে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানের উন্নত মনুষ্য প্রজাতিতে তথা মানুষে রূপান্তরিত হয় ।
২. পুরোপলীয় যুগের খাদ্য : পুরোপলীয় যুগের মানবগোষ্ঠী বন্যদশাগ্রস্ত থাকার কারণে খাদ্য উৎপাদন করার কথা কখনও ভাবেনি । এজন্য তাদেরকে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকতে হতো। তারা উন্মুক্ত প্রকৃতি থেকে ফলমূল, পাখির ণা ডিম, গাছ ও ঘাসের কচি পাতা, নদী ও ঝরনার পানি ইত্যাদি খেয়েই ক্ষুধা নিবারণ করতো। সময় পরিবর্তনের সাথে [ন সাথে প্রকৃতিনির্ভর মানুষেরা শিকারি জীবনের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে। এ যুগের প্রথমদিকে তারা খরগোশ, বনমোরগ
প্রভৃতি ছোট প্রাণী শিকার করে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করতো। পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধভাবে হরিণ, বাইসন, রি মহিষ শিকার করার পদ্ধতি রপ্ত করে ।
৩. মাতৃতান্ত্রিক সমাজ : পুরোপলীয় যুগের প্রথমদিকে সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তখন নারী-পুরুষের কাজের রা মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হতো না। নারী-পুরুষ সবাই মিলে খাদ্য সংগ্রহের কাজ করতো। তবে সংসারে মেয়েদের বেশকিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতো। যেমন— সন্তানের জন্ম দেওয়া, তাদের লালনপালন করা প্রভৃতি । ধ পুরুষরা যখন শিকারের জন্য গৃহের বাইরে যেত তখন মেয়েরা বাসস্থানের কাছাকাছি থেকে মাংস কাটা, চামড়া ও সেলাই করে পোশাক তৈরির কাজ করা, সন্তান লালনপালন করা, পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে সংগৃহীত আগুন বেশি সময় ধরে জ্বালিয়ে রাখা এবং ঘরসংসারে যাবতীয় শৃঙ্খলার কাজ সম্পাদন করতো। এভাবে সমাজে মেয়েদের গুরুত্ব বেড়ে 5 যাওয়াতে মেয়েরাই সমাজের বেশি কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে পড়ে। যে কারণে পুরোপলীয় যুগের প্রথমদিকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রাধান্য লাভ করে ।
৪. সাম্যবাদী সমাজ : সাম্যবাদী সমাজ ছিল পুরোপলীয় যুগের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পুরোপলীয় সমাজের মানুষ 1 বিশ্বাস করতো যে, সবাই একত্রিত হয়ে শিকার ও অন্যান্য কাজ করাই উত্তম। এ কারণে কাজে ফাঁকি দেওয়ার মতো চিন্তা
তাদের ছিল না'। এ সাম্যবাদী আদর্শের ভিত্তিতেই তাদের ভাবাদর্শ গড়ে উঠেছিল ।
৫. অস্ত্রশস্ত্র ও অনুরূপ দ্রব্যাদি : পাথরের তৈরি বিভিন্ন হাতিয়ার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ছিল পুরোপলীয় যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পাথরের তৈরি বিভিন্ন প্রকার ধারালো অস্ত্র পুরোপলীয় যুগের মানুষের জীবনধারণের অন্যতম প্রধান
i অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। পুরোপলীয় সমাজের মানুষেরা তার আশপাশের পাথর ভেঙে ধীরে ধীরে ব্যবহার উপযোগী করে তুলত। প্রকৃতপক্ষে, পুরোপলীয় যুগের অস্ত্রশস্ত্র বলতে যা ছিল তা হলো একটি পাথরকে ভেঙে কোনোরকমে ব্যবহার উপযোগী করা অর্থাৎ বিরাট পাথর ভেঙে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে তা দিয়ে প্রাণীকে আঘাত করার ব্যবস্থা করা। এ যুগে পাথরের অমসৃণ ও স্থূল অস্ত্র ব্যবহৃত হতো । চিতি
৬. আবাসস্থল : বন্যদশাগ্রস্ত পুরোপলীয় যুগের মানুষের কোনো স্থায়ী আবাসস্থল ছিল না। শিকারের খোঁজে তাদের যাযাবর জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করতে হতো। এ যুগের শুরুর দিকে মানুষ উন্মুক্ত ও খোলা স্থানেই বসবাস করতো। গরম আবহাওয়া অঞ্চলের মানুষেরা তখন গাছের কোঠরে, বড় গাছের ডালে এবং মাটিতে বড় গর্ত করে সে গর্তে বসবাস করতো। এ যুগের শেষদিকে মানুষ গাছের ডালপালা, পশুর হাড় ও চামড়া দিয়ে তাবু তৈরি পদ্ধতি বের করে। শীত প্রধান অঞ্চলের মানুষ শীত হতে বাঁচার জন্য গুহা হতে পশুদের তাড়িয়ে দিয়ে গুহায় বসবাস শুরু করে। গুহার মধ্যকার বিভিন্ন চিত্র যেতে মানুষের গুহাবাসী জীবনের প্রমাণ পাওয়া যায় ।
৭. পোশাক-পরিচ্ছদ : পুরোপলীয় যুগে মানুষের পোশাক বলতে তেমন কিছুই ছিল না বা তারা তৈরি করতে পারেনি। লজ্জা নিবারণ কিংবা শালীনতার চেয়ে প্রচণ্ড শীতের কবল থেকে বাঁচার জন্যই মূলত মানুষের পোশাকের প্রয়োজন হতো। ধারণা করা হয়, পুরোপলীয় যুগের প্রথমদিকে মানুষ গাছের বাকল ও পাতাকে পোশাকের মতো ব্যবহার করতো। বড় পশু শিকার করার পর তারা বুঝতে পারে যে, পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখলে শীত অনেক কম অনুভব হয়। তখন থেকেই চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত করে ।
৮. আগুনের ব্যবহার : পুরোপলীয় যুগের মানুষ কৃত্রিমভাবে আগুন জ্বালানোর কৌশল জানত না। তবে তারা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি যেমন— বজ্রপাত, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি হতে আগুনের ধারণা লাভ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ঐসব উৎস থেকে আগুন সংগ্রহ করে বনের কাঠ জ্বালিয়ে আগুন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জালিয়ে রাখত। প্রথমদিকে পুরোপলীয় যুগের মানুষ আগুন ব্যবহার করেই শীত নিবারণ এবং বন্যপশুদের আক্রমণ হতে নিজেদের নিরাপদ রাখত। ধীরে ধীরে আদিম মানুষেরা মাংস আগুনে পুড়ে বা ঝলসে খাওয়ার শিক্ষা আয়ত্ত করে ফেলে ।
৯. কথা বলার ক্ষমতা অর্জন : পুরোপলীয় সমাজের মানুষ যখন ধীরে ধীরে বড় বড় প্রাণী শিকার করতে শুরু করে তখন তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় ও সহযোগিতার মনোভাবের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা থেকেই তারা ভাবভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে ভাবের ও সংবাদের আদানপ্রদান করা শুরু করে। তাছাড়া তারা প্রয়োজনের তাগিদেই ক্রমশ অর্ধোচ্চারিত শব্দ ব্যবহার করতে শিখে। উল্লেখ্য, প্রথমদিকে আদিম মানুষের মুখ গহ্বরের স্থান কম ছিল বলে স্পষ্ট শব্দ উচ্চারণে কিছুটা সমস্যা হতো। কিন্তু এরপর থেকে মানুষের মুখ গহ্বরের স্থান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলে মানুষ স্পষ্ট উচ্চারণ করে কথা বলার পদ্ধতি শিখে ফেলে ।
১০. যৌথ বিবাহ : পুরোপলীয় যুগে সমাজে যৌথ বিবাহের প্রচলন ছিল। যেমন— একটি ক্ল্যানের বা ট্রাইবের সব পুরুষ মিলে অন্য ক্ল্যান বা ট্রাইবের সব মেয়েদের বিয়ে করতো। এরকম যৌথ বিবাহের ফলে যে সন্তান জন্মলাভ করতো সে তার মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হতো। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে জন্মগ্রহণ করায় সন্তানেরা মায়ের সাথে সাথেই থাকত ৷ উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবসমাজ বিকাশে পুরোপলীয় বা প্রাচীন প্রস্তর যুগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যদিও পুরোপলীয় যুগে মানবসমাজ ছিল পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। তবে এ প্রকৃতিনির্ভরতায় মানুষকে যেমন প্রাকৃতিক অনেক ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা লাভ করেছিল তেমনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছিল। এ সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত মানুষ জয়ী হয় এবং ধীরে ধীরে মানব সভ্যতা উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]