মধ্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : মানব সভ্যতা বিকাশে মধ্য প্রস্তর যুগের অবদান অপরিসীম। ইউরোপে প্রায় দশ হাজার খ্রিস্টপূর্বে এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় আরও পরে শুরু হয়। মধ্য প্রস্তর যুগটি প্রাচীন প্রস্তর যুগের প্রান্তিক সময়। মধ্য প্রস্তর যুগ অনেকাংশে প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকে সংক্ষিপ্ত এবং স্বাতন্ত্র্যসূচক। মধ্য প্রস্তর যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একাধারে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের যুগ হিসেবে বিবেচিত। বহু ক্ষেত্রে ম্যাগডালেনীয় ও মেসোলিথিক যুগের হাতিয়ার নির্মাণ, শিল্পচর্চা, সংস্কৃতি প্রায় একই রকম মনে হলেও মেসোলিথিক যুগের সংস্কৃতি ছিল অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ, সৃজনশীল এবং গতিময়।
• মধ্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে মধ্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. খাদ্য : মাংস ও মাছ মধ্য প্রস্তরযুগে মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা একটি গাছকে মধ্যভাগে গোলাকার করে কেটে ক্যানু তৈরি করতে শিখে এবং সেটি দিয়ে পানিতে (হ্রদে) মাছ শিকার করতো। এসময় থেকেই মানুষের প্রিয় খাদ্য, এমনকি প্রধান খাদ্য হিসেবে মাছ বিবেচিত হয়ে আসছে। তারা প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরে সেই মাছ শুঁটকি করে ভবিষ্যতের জন্য প্রচুর পরিমাণ খাদ্য সংরক্ষণ করতো। যদি কখনও তারা জঙ্গলে শিকার করতে না পারত, তবুও তারা নিরাশ হতো না। তখন তারা সেই সংরক্ষিত খাদ্য আহার করতো। রান্নার সরঞ্জাম, মৃৎপাত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি বিধায় এ যুগের মানুষ মাছ ও মাংস আগুনে পুড়িয়ে খেত। এ যুগে মাছ ও মাংস ছাড়াও শাকসবজি ও ফলমূল খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে মাছ তাদের অতি প্রিয় খাদ্য ছিল সেটা স্বাদু পানির মাছই হোক, আর লোনা পানির মাছই হোক । মাছের মধ্যে সিল, স্যালমন, ট্রাউট ছিল প্রধান ।
.
২. পোশাক : মধ্য প্রস্তরযুগে মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে তেমন জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, তারা কাপড় তৈরি করতে না পারলেও লজ্জা নিবারণের জন্য পশুর চামড়া ব্যবহার করতো। তাছাড়া তারা শীত নিবারণের জন্য পশুর চামড়া, হাড়ের সুচ দ্বারা জোড়া দিয়ে (সেলাই করে) বড় আকারের পোশাক পরিধান করতো। অনেক সময় তারা গাছের ছালও পরিধান করতো ।
৩. বাসস্থান : মধ্য প্রস্তরযুগে মানুষ গুহায় বসবাস না করলেও শীতের সময়ে সাময়িকভাবে গুহায় কিংবা মাটির গর্তে আশ্রয় নিত। তবে বাকি সময়গুলোতে তারা হ্রদের বা জলাশয়ের তীরে উন্মুক্ত সমতল ভূমিতে বসবাস করতো। এ যুগের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল পূর্ববর্তী মানুষের জীবনযাত্রা অপেক্ষা সহজতর। তারা ৪-৫টি করে কুঁড়েঘর তৈরি করতে শিখে পারিবারিক তথা সামাজিক পরিবেশের সৃষ্টি করে। গম্বুজাকৃতির এসব চালাঘরের নিদর্শন ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার ও ডেনমার্ক পাওয়া যায় ।
৪. আগুন ব্যবহার : মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ আগুন জ্বালাতে পারদর্শী ছিল বিধায় তারা বিভিন্ন কাজে আগুন ব্যবহার করতো। চকমকি পাথরের সাহায্যে তারা আগুন জ্বালাত। প্রথম পর্যায়ে মাটির পাত্র না থাকায় তারা আগুনে মাছ ও মাংস পুড়িয়ে খেত। পরে মাটির পাত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর খাদ্য আগুনে সিদ্ধ করে খেত। প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচার জন্য তারা আগুন পোহাত ৷
৫. জীবিকা : পশু ও মৎস্য শিকার ছিল এ যুগে মানুষের প্রধান জীবিকা । অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন পশু শিকার করার সময় তারা শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি বুদ্ধি এবং কৌশলও প্রয়োগ করতো। ফলে তারা প্রচুর পরিমাণে শিকার করতে পারত । এ যুগে মানুষ স্থলভাগে তিরধনুক দিয়ে পশু শিকার করতো, আর মাছের চলার গতিপথ লক্ষ করে সেই পথে জাল রাখত এবং প্রচুর পরিমাণে মাছ শিকার করতো। এছাড়া হ্রদের পানিতে মাছ শিকার করার জন্য তারা বেত, বাঁশ প্রভৃতি দ্বারা নির্মিত গোলাকার ‘কোরাকল' নামক ভেলা, গাছের গুঁড়ি, গাছ খুঁড়ে তৈরিকৃত ক্যানু, কাঠের পানসি নৌকা এবং বিভিন্ন প্রকার ভেলা ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। তাছাড়া তারা ফাঁদ পেতে বিবর, নেউল, শৃগাল, বনবিড়াল এসব ছোট পশু শিকার করতো । এ যুগে সীমিত আকারে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়। এ যুগের মানুষ গরু, কুকুর প্রতিপালন করতো। তবে কৃষিকাজ তাদের পেশা ছিল না । ·
৬. হাতিয়ার : মধ্য প্রস্তর বা মেসোলিথিক যুগের সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো হাতিয়ার। তির ও ধনুকের ব্যবহার ছিল যুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তির বা বর্শা হাত দিয়ে নিক্ষেপ না করে নিপুণ হাতে শিকারি ধনুক ব্যবহার করে অব্যর্থ লক্ষ্যে শিকার বধ করতে শিখে। এ যুগের মানুষরাও পাথরের তৈরি হাতিয়ারের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। পাথরের হাতিয়ারগুলোকে বলা হতো মেসোলিথিক বা মাইক্রোলিথ বা ক্ষুদ্রাকার পাথরের হাতিয়ার । ফ্রান্সের কুইবেকন উপদ্বীপের টেভিস দ্বীপে প্রাপ্ত সুচালো পাথরের তৈরীকৃত তিরের ফলা ব্যবহার করে শিকারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ম্যাগলেমোসিয়ান নামক এক গোষ্ঠী কর্তৃক পশুর চামড়া ছড়ানোর জন্য এক ধরনের ধারালো পাথর ব্যবহৃত হতো। এ ম্যাগলেমোসিয়ান গোষ্ঠী পূর্বে বাল্টিক রাষ্ট্রে বসবাস করতো এবং তারা হ্রদের নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতো। শিকার কাজে তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে হাড়ের সুচালো মাথা, ত্রিকোণাকার পাথরের কণা বা তির, খাঁজকাটা শিং ইত্যাদি ।
৭. ভাষার উদ্ভাবন : ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ বাহন। এটি মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে মনে করা হয় । মানুষের ভাষা কখন, কোথায় আবিষ্কৃত হয় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। অনুমান করা হয়, মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য নিজেই তার ভাষার উদ্ভাবন করেছে। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, মধ্য প্রস্তরযুগে মানুষ হিংস্র প্রাণীর কবল থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারস্পরিক ভাব আদানপ্রদান করতে গিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দ উচ্চারণের
মাধ্যমে ভাষার প্রয়োগ করে।
৮..শিল্পকর্ম : মধ্য প্রস্তরযুগে শিল্পকর্মের চর্চা হলেও পূর্ববর্তী যুগের মতো সৃজনশীলতা তেমনভাবে লক্ষ করা যায় না। তাদের চিত্রকর্মে পাথরের ওপর আদিম অস্ট্রেলীয় উপজাতিদের মতো রঙের প্রলেপ ব্যবহার করা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফ্রান্সের এরিজেতে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ অব্দে পার্থরের নুড়ির ওপর নকশা অঙ্কিত হয় চিত্রটি ছিল বিস্ময়কর। ডেনমার্কে প্রাপ্ত নিদর্শনে আদিম মানুষের শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। সুইডেনে প্রাপ্ত কিছু মৎস্যাকৃতির ছবিতে জ্যামিতিক নকশা লক্ষ করা যায়। সুইডেন, রাশিয়া এবং ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় এ যুগের গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশেরই অবস্থান ছিল নদী বা সাগরতীরে। ছবিতে নদী বা সাগরনির্ভর মানুষের জীবন জীবিকার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
৯. অলংকারের ব্যবহার : মধ্য প্রস্তরযুগে মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের মতো শৌখিন প্রকৃতির ছিল। এ যুগে নারী- পুরুষ উভয়েই বিভিন্ন ধরনের অলংকার পরিধান করতো। তাদের সৌন্দর্যবোধ অনেকাংশে আধুনিক মানুষের মতো ছিল। কেশবিন্যাস করার জন্য হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার, পাখির পালক, গাছের লতাপাতা, ফুল ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। পুঁতি, পুঁতির মালা, গলার হার, কোমরবন্ধ, হাঁটুবন্ধ, বাজুবন্ধ, বালা, ঝিনুক, ঝুমকা, মাথার পিন ইত্যাদি মধ্য প্রস্তর যুগের। সর্বাপেক্ষা প্রিয় ও আকর্ষণীয় এসব অলংকার তৈরি করার জন্য পাথর, হাতির দাঁত, হরিণের শিং, ঝিনুক প্রভৃতি ব্যবহৃত হতো।
১০. মৃতের সৎকার সাধন : মধ্য প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির মধ্যে মৃতের সৎকার একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছিল । মৃত ব্যক্তিকে সৎকারের পূর্বে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। আলজেরিয়ার বেনিসেগোবাল এবং ম্যাটাচায়েল এরবিতে মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষের মাথার খুলি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, মাথাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বিকৃত অবস্থায় সমাহিত করা হয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, তৎকালে মানুষ হত্যা করে সর্বাধিক মাথার খুলি সংগ্রহ করা একটি গৌরবজনক বিষয় বলে বিবেচিত হতো। ব্যাভেরিয়ার এফরেট থেকে এরূপ আবিষ্কৃত গণকবর থেকে সর্বমোট ৩৩টি মাথার খুলি পাওয়া গেছে। এ ৩৩টি মাথার মধ্যে ২০টি ছিল মহিলার, আর ৯টি শিশুর। নৃতাত্ত্বিকগণ এ গণকবর থেকে প্রাপ্ত মাথার খুলিগুলো পরীক্ষা করে ধারণা করেছেন যে, সম্ভবত মহিলা ও শিশুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মধ্য প্রস্তর যুগ প্রাচীন প্রস্তর যুগ ও নব্য প্রাচীন প্রস্তর যুগের মধ্যবর্তী সময় হিসেবে বিবেচিত ছিল। দুটি যুগের মধ্যবর্তী যুগ বলে এসময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তবে এটা যুগ পরিবর্তনের সময় ছিল। এটা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। এ যুগ থেকেই আদি মানুষ পশুশিকার ও খাদ্য সংগ্রহ স্তর অতিক্রম করে আজকের সভ্য সমাজে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এ যুগ পরিক্রমায় কৃষিকার্য, সমাজবদ্ধ জীবন, সংস্কৃতি উৎকর্ষের মাধ্যমে নব্য প্রস্তরযুগে প্রবেশ করে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]