নবোপলীয় যুগ কী? এ যুগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকগুলো আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : মানবসমাজ বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধ বা পর্যায় হলো নব্য প্রস্তর যুগ বা নবোপলীয় যুগ। প্রাগৈতিহাসিক বা প্রাচীন পাথরের যুগের শেষ ধাপ নব্য প্রস্তর যুগ বা নবোপলীয় যুগ নামে পরিচিত। নবোপলীয় যুগকে মসৃণ পাথর ও ধাতু ব্যবহারের যুগ বলা হয়। নবোপলীয় যুগে মানুষ নতুন হাতিয়ারের মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতির সূচনা করে। তার সাথে সাথে পশুপালন, ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা প্রভৃতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। ফলে মানবসমাজের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
নব্য প্রস্তর যুগ : প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষ ধাপ নব্য প্রস্তর বা নবোপলীয় যুগ নামে পরিচিত। নবোপলীয় যুগকে মসৃণ পাথর ও ধাতু ব্যবহারের যুগ বলা হয়। নবোপলীয় বা নব্য প্রস্তর যুগের প্রারম্ভিক কাল নির্ণয় করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। প্রচলিত ধারণা অনুসারে, পুরানো প্রস্তর যুগের সমাপ্তির পর মধ্য প্রস্তর যুগ দশ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় এবং ছয়/সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ যুগের অবসানের পর নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। নবোপলীয় যুগে মানুষ পাথরকে নতুনভাবে করায়ত্ত করে এর দ্বারা অপেক্ষাকৃত উন্নত, মসৃণ ও ধারালো অস্ত্র তৈরি করে এবং কৃষিকাজসহ নানাভাবে পাথরকে সার্থকরূপে ব্যবহার করে সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনে। যাকে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ভি. গর্ডন চাইল্ড নবোপলীয় বিপ্লব (Neolithic Revolution) বলে অভিহিত করেন।
নব্য প্রস্তর যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা : নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ উদ্যানভিত্তিক কৃষির সূচনার সাথে সাথে অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা ও কাঠামো বিনির্মাণ করতে শুরু করে এবং এসময়ে মানব সভ্যতার সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য গোটা সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে। নব্য প্রস্তর যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো : ১. উদ্যানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন : নবোপলীয় যুগে বৈপ্লবিক আবিষ্কারসমূহের মধ্যে নারীসমাজ কর্তৃক উদ্যানভিত্তিক কৃষি পদ্ধতির উদ্ভাবন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কৃষির অগ্রগতির ফলে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী জীবনের পরিবর্তে খাদ্য উৎপাদনকারী শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। কৃষির উদ্বৃত্ত ফসল সভ্যতার সূচনা করে। উদ্বৃত্ত ফসল মানুষ পার্শ্ববর্তী গোত্রের নিকট বিনিময়ের মাধ্যমে বিনিময় প্রথার সূচনা ঘটায় । এভাবে কৃষি গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটে ।
২. পশুপালনের সূচনা : নবোপলীয় যুগের অপর একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ হলো পশুপালন পদ্ধতির সূচনা ৷ বুনো ঘাস জমিতে উৎপন্ন হওয়ায় সে ঘাস যাওয়ার লোভে বিভিন্ন তৃণভোজী প্রাণী খেতের কাছে আসত এবং মানুষ সে পশুগুলোকে ধরে ফেলত। একসাথে অনেক পশু ধরা পড়লে মানুষ সবগুলো জবাই না করে কিছু কিছু পশু পোষ মানানোর চেষ্টায় মনোযোগ দেয় । এভাবে পশুপালন নবোপলীয় যুগে মানুষের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে ।
৩. কুমারের চাকা আবিষ্কার : কুমারের চাকা আবিষ্কার নবোপলীয় যুগে অর্থব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিবর্তন আনে। কুমার চাকা আবিষ্কার করার ফলে তাদের উৎপাদন আরও বেড়ে যায়। উৎপাদন বৃদ্ধি নবোপলীয় যুগের মানুষের অর্থনীতিতে সচ্ছলতা আনতে সাহায্য করে । তাছাড়া চাকা আবিষ্কারের ফলে মৃৎশিল্পের গুণগত মানও বৃদ্ধি পায় ।
৪. ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতির উদ্ভাবন : নবোপলীয় যুগে অর্থনীতি প্রধানত কৃষি ও পশুপালনের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে । পশুপালক গোষ্ঠীর হাতে সাধারণত সারা বছরই পর্যাপ্ত পরিমাণ পশু, মাংস, পশুর লোম প্রভৃতি জমা থাকত এবং একইভাবে কৃষক গোষ্ঠীর নিকট সবসময়ই শস্য জমা থাকত। যে কারণে পশুপালক গোষ্ঠী শস্যের জন্য কৃষকের ওপর নির্ভর করতো এবং একইভাবে কৃষক শ্রেণি মাংস, লোম ও হাড়ের জন্য পশুপালকের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করতো। এরূপ নির্ভরশীলতার ফলে মানুষের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা হয় ।
৫. বিনিময় প্রথা : নব্য প্রস্তরযুগে পরস্পর নির্ভরশীলতা আবার বিনিময় প্রথার সূত্রপাতও ঘটায়। বিনিময় প্রথার প্রথমদিকে সাধারণত গরুর সাথে বিভিন্ন কৃষি পণ্য, যেমন— গম বা ধান বিনিময় করা হতো। বর্তমানে আমরা যেমন টাকার মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্যাদি ক্রয় করে থাকি তেমনিভাবে নবোপলীয় যুগে সর্বপ্রথম গরু, লবণ ও চামড়া দিয়ে ক্রয়-বিক্রয়ের সূচনা হয় । ৬. তামার ব্যবহার : মানব সভ্যতা অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নবোপলীয় যুগের শেষদিকে মানুষ কোনো কোনো স্থানে তামার আকরিক উত্তপ্ত করে তামার হাতিয়ার তৈরি করে। তামা ধাতুর সাহায্যে এসময় মানুষ নানা আকারের ধারালো হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়। তামা অনেক ঘাত সহনীয় বিধায় এ ধাতু দ্বারা কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়। বিশেষ করে লাঙলের ফাল তামা দ্বারা তৈরি করার ফলে নবোপলীয় যুগের শেষদিকে কৃষি উৎপাদন বৈপ্লবিকভাবে বৃদ্ধি পায় । এভাবে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে ।
৭. শস্য সংরক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবন : কৃষি পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের শস্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সাথে শস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। এজন্য নবোপলীয় যুগের মানুষ প্রথমে শস্য মাটির গর্তে রাখার কৌশল উদ্ভাবন করে। তারা মাটির গর্তের ভিতরে খড় বা বেত গোল করে ঘুরিয়ে বিছিয়ে একটা আস্তরণ তৈরি করে এবং এরপর সেখানে শস্য রাখার কৌশল বের করে। ধীরে ধীরে মানুষ মাটির কয়েক হাত উপরে শস্যগোলা তৈরি করে শস্য সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করে। শস্য উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করার ফলে মানুষকে খাবারের সংকটে পড়তে হয়নি। ফলে মানুষ অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে যেমন রক্ষা পায় তেমনি অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়।
৮. বুনন পদ্ধতির উদ্ভাবন : নব্য প্রস্তরযুগে বুননের ক্ষেত্রে মানুষ নতুন আশার আলো সঞ্চার করে। এ যুগে তুলা, শন বা অন্য কোনো উদ্ভিদের আঁশকে পাকিয়ে সুতা তৈরি করা হতো। তাছাড়া পশুর লোম দিয়েও সুতা তৈরি করে কাপড় বোনা হতো। এরপর সুতা কাটার জন্য মানুষ ক্রমশ চরকা আবিষ্কার করে। চরকা আবিষ্কার বুননের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করে এবং এ আবিষ্কারের ফলে মানুষের সুতা কাটা অনেক দ্রুত ও সহজতর হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে কাপড় বোনা পদ্ধতি মানুষ আয়ত্ত করে নেয়। নবোপলীয় যুগে কাপড় বোনার যে পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় তা ক্রমে উন্নত হয়ে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ।
৯. স্থায়ী বসতি নির্মাণ : নব্য প্রস্তরযুগে কৃষি আবিষ্কারের ফলে মানুষ নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিশেষত যেখানে কৃষি উৎপাদন ভালো সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ফলে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। তারা এ যুগের শেষদিকে গৃহনির্মাণ করতে শুরু করে। গৃহ তৈরির জন্য তারা গাছের ডালপালা, লতাপাতা, ঘাস প্রভৃতি উপাদান ব্যবহার করতো। এ বসতি অঞ্চল ধীরে ধীরে গ্রামে পরিণত হয় । কোথাও কোথাও এ গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । নগর ব্যবস্থা নবোপলীয় যুগের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিকাশ ঘটায় ।
১০. তৈজসপত্র আবিষ্কার : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ সাংসারিক প্রয়োজনে বাঁশ-বেতের ঝুড়ি, পোড়া মাটির বাসন প্রভৃতি তৈরি করার প্রক্রিয়া আয়ত্ত করে। মানুষের বানানো পাত্রকে আরও মসৃণ করার জন্য আঙুল দিয়ে টিপে এবং বারবার হাত ঘুরিয়ে সুন্দর করা হয় । এ যুগে মেয়েরা ধান ও গমের খোসা ছাড়াতে একটি পাথরের ওপর গম বা ধান রেখে অন্য পাথর দিয়ে ঘষা দিয়ে খোসা ছাড়ানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এসব যন্ত্র একদিকে মানুষের কাজসমূহকে আরামদায়ক করে তোলে। অন্যদিকে, যাতার অর্থাৎ শস্য চূর্ণ করার যন্ত্রের অর্থনৈতিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ যন্ত্রগুলো মানুষকে কিছুটা বাড়তি আয় এনে দিতে সক্ষম হয় । তৈজসপত্রের আবিষ্কার মানুষকে চিত্রশিল্পে উৎসাহ দেয়। মানুষ ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজে তৈজসপত্র ব্যবহার করতে থাকে । এতে তৈজসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে থাকে । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন হাতিয়ারের উন্নতির ফলে এসময় কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজে বিনিময় প্রথা, পশুপালন, তৈজসপত্রের প্রচলন, শস্য সংরক্ষণ পদ্ধতির প্রচলন প্রভৃতি দেখা যায়। ফলে নব্য প্রস্তরযুগে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় । এভাবে নব্য প্রস্তরযুগে একটি বিপ্লব সাধিত হয় । যা নবোপলীয় বিপ্লব নামে অভিহিত ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]