নব্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দাও।

উত্তর ভূমিকা : নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ গুহা ছেড়ে সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন করে। সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ প্রস্তর যুগের মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার চেয়ে বেশ উন্নত ছিল। এ যুগে মানুষের পারিবারিক, গোষ্ঠীগত ও সামাজিক বন্ধন পূর্বের তুলনায় সুদৃঢ় হয় এবং মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। জীবনধারণের প্রয়োজনে এসময় মানুষ হাতিয়ারের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করার পাশাপাশি তারা অনেক নতুন হাতিয়ারেরও উদ্ভাবন করে ।
● নব্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে নব্য প্রস্তর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. খাদ্যাভ্যাস : খাদ্য উৎপাদনের ফলে নবোপলীয় যুগে মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপলীয় যুগের মানুষের জীবনযাত্রার চেয়ে অনেক সহজতর ছিল । কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে তারা স্থায়ী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এ যুগে মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল কৃষিজ পণ্য। এগুলোর মধ্যে ভুট্টা, গম ও বার্লিই ছিল প্রধান। আমেরিকান-ইন্ডিয়ানরা শিম, কুমড়া ও গোলআলুসহ অন্যান্য ফসল চাষ করতো। ধারণা করা হয় নবোপলীয়রা আমিষ ও নিরামিষভোজী ছিল। প্রধান খাদ্য তালিকার অন্যতম ছিল রুটি। তারা আটা দিয়ে রুটি তৈরি করতে পারত । নবোপলীয়রা আমিষ হিসেবে গরু, ছাগল, কুকুর, হরিণ, বাঘ প্রভৃতির মাংস ভক্ষণ করতো। এরা গরু ও ছাগলের দুধও পান করতো। এছাড়া তারা মধুও আহরণ করতে সক্ষম ছিল। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ খেজুর, ডুমুর, ‘জলপাইসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেত। মাংসের পাশাপাশি মাছও ছিল তাদের অন্যতম খাদ্য উপাদান।
২. পোশাক-পরিচ্ছদ : নব্য প্রস্তর যুগীয় মানুষের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো বয়নতন্তুর আবিষ্কার। তারা । উদ্ভিদজাত ও পশুজাত তন্তু থেকে সুতা তৈরি করে সেই সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি করতে পারত। তৎকালে শণ, অতসী, । তুলা থেকে উদ্ভিদজাত এবং ভেড়া ও ছাগলের পশম থেকে পশুজাত তন্তু তৈরি করে বিভিন্ন রকমের কাপড় প্রস্তুত করা হতো। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দে সিদ্ধান্তে সুতা উৎপাদনের জন্য তুলার চাষ হতো। সে সময়ে তাঁতে । কাপড় বোনার ক্ষেত্রে মেয়েরা পারদর্শিতা অর্জন করতে শেখে। তাদের তৈরি ও পরিধানকৃত পোশাক-পরিচ্ছদে বিভিন্ন ধরনের কারুকার্যেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডের একটি স্থানে হ্রদের পানি অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেলে হ্রদের তলদেশে আদিম (নব্য প্রস্তর) যুগের মানুষের পোশাক পাওয়া যায় ।
¡ .৩. আবাসস্থল : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ বসবাসের জন্য গৃহ নির্মাণ করতে শেখে। তারা গাছপালা ও প্রস্তর দ্বারা তাদের বাসগৃহ নির্মাণ করতো । তবে ব্রোঞ্জ যুগের আগে টুল বা চেয়ার এবং টেবিলের প্রচলন হয়নি । কোনো প্রকার আসবাবপত্র না থাকায় তারা মাটির মেঝেতে পরিবার পরিজনদের নিয়ে বসত এবং তারা মাটিতে বিছানা পেতে শয়ন করতো বলে ধারণা করা হয় ।
৪. চিকিৎসা সেবা : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ বিশ্বাস করতো যে, অপদেবতাদের প্রভাবে মানুষের বিভিন্ন প্রকার অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা রোগের প্রতিকারের জন্য জাদুবিদ্যাই বেশি প্রয়োগ করতো। তবে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ ক্ষত চিকিৎসার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ বিভিন্ন গাছগাছড়া, লতাপাতা, ফলমূল ও বিভিন্ন ধরনের গুল্মের ব্যবহারও করতো। নব্য প্রস্তর যুগের শেষদিকে কিছু শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় ।
৫. শিক্ষাব্যবস্থা : নব্য প্রস্তরযুগেই প্রথম পারিবারিক পরিবেশে সাংস্কৃতিক শিক্ষার সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে সে শিক্ষা সমাজে বিশেষ স্থান লাভ করে এবং উত্তরোত্তর এর উন্নতি ঘটতে থাকে। নব্য প্রস্তরযুগে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বংশপরম্পরায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো ।
৬. কৃষি আবিষ্কার : নব্য প্রস্তর যুগে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের মধ্যে কৃষি অন্যতম। মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় কৃষির আবিষ্কারকে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলে চিহ্নিত করা হয়। কৃষি উদ্ভাবনের ফলে খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষ খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত হয়। এর মাধ্যমে মানুষ যাযাবর বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কৃষি উৎপাদনের ফলে মানুষের অভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। এ যুগে তারা বিভিন্ন রকম ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয় । নব্য প্রস্তরযুগে সবজি এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য; যেমন— ভুট্টা, অতসী, তামাক, শিম, কুমড়া, গোলআলু ইত্যাদি উৎপাদিত হতো। এছাড়া এসময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুর, আঙুর, ডুমুর, জলপাই প্রভৃতি চাষ করা হতো ।
৭. পশুপালন : নব্য প্রস্তর যুগের শিকারি মানুষ উন্নত হাতিয়ার ব্যবহারের ফলে পর্যাপ্ত শিকার পেত। অনেক সময় উদ্বৃত্ত পশু হত্যা না করে পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেওয়া হতো। এভাবে দিনে দিনে পশুগুলো গৃহপালিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা আবিষ্কার করে যে, এগুলোকে হত্যা না করে প্রতিপালন করা অধিকতর লাভজনক। অন্যদিকে, তৃণভোজী পশুগুলো মানুষের কৃষিক্ষেত্রের আকর্ষণে লোকালয়ের কাছে চলে আসত। এসব পশু নিরীহ ও দুর্বল ছিল বলে সেগুলোকে অতি সহজেই বশে আনা যেত । নব্য প্রস্তর যুগের গৃহপালিত পশুর মধ্যে কুকুর, গরু, মহিষ, ছাগল, শূকর, ভেড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । ৮. সমাজবদ্ধ জীবন : পৃথিবীতে মনুষ্যসৃষ্ট সর্বপ্রাচীন ও সর্বপ্রথম একটি সামাজিক সংগঠন হলো পরিবার। পরিবার নামক এ প্রাচীন সামাজিক সংগঠনটি সর্বপ্রথম নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের উদ্ভাবন হিসেবে ধরা হয়। নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ যৌথ পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তখন একাকী বাস করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কারণ বন্য হিংস্রজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দলবদ্ধভাবে মানুষ বসবাস শুরু করে। পরিবারের বা গোষ্ঠীর কেউ অপরাধ করলে শাস্তিস্বরূপ তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হতো, যা ছিল মৃত্যুদণ্ডের শামিল। কারণ তৎকালে মানুষ হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে একা আত্মরক্ষা করতে ব্যর্থ হতো। যৌথ পরিবারের একজন প্রধান থাকত। যার নির্দেশক্রমেই পারিবারিক জীবন নির্বাহ ও পরিচালিত হতো। নব্য প্রস্তরযুগে বিবাহের প্রচলন হয়। এমনকি বহুবিবাহ প্রথাও প্রচলিত ছিল ।
৯. শিল্পকলা : নব্য প্রস্তরযুগে শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান হলো মৃৎপাত্র। এসময় মৃত্তিকা দ্বারা নানা আকৃতির এবং নানাবিধ নকশার মৃৎপাত্র তৈরি হতে থাকে। এসব মৃৎপাত্র গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া নব্য প্রস্তর যুগের শিল্পীরা মাটি দিয়ে নানারকমের পুতুল ও মূর্তি তৈরি করতো। জেরিকো (প্যালেস্টাইন), জারমো (ইরাক) থেকে এ ধরনের মাটির শিল্পকর্ম আবিষ্কার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মূর্তি রয়েছে। এগুলোকে মাতৃকা মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
১০. হাতিয়ার : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ পূর্ববর্তী সময়ের হাতিয়ারগুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয় । তাছাড়া তারা উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক নতুন হাতিয়ারেরও উদ্ভাবন করে। এসময় তারা পাথর, কাঠ, বাঁশ, হাড় প্রভৃতি দ্বারা হাতিয়ার তৈরি করতো। নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের হাতিয়ারগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও তীক্ষ্ণ। এসময় কুঠার, চাকু, কোদাল, গাঁইতি, বর্শা ও তিরসহ বিভিন্ন রকম হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হতো ।
১১. বিনোদন ব্যবস্থা : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নাচগান, খেলাধুলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ তারা করে আনন্দ লাভ করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নব্য প্রস্তুর যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তারা বেশ উন্নত ছিল। এ যুগের মানুষ ছিল একটি নতুন যুগ সৃষ্টিকারী মানবগোষ্ঠী। একদিকে তারা যেমন পূর্ববর্তী যুগের সংস্কৃতিকে উন্নত করেছে, তেমনি অনেক নতুন সংস্কৃতিও তারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। কৃষি, পশুপালন, দ্রব্য বিনিময় প্রথাসহ নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে এ যুগে। তাছাড়া এ যুগের মানুষ শিল্পকলায় বিশেষ অবদান রাখতেও সক্ষম হয় । এককথায়, নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রা পূর্ববর্তী সব মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত ধরনের ছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]