অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

Characteirstics of the Peasant Resistence Movement in the 18th and 19th Century
প্রতিরোধ আন্দোলন ও নিম্নবর্গের ইতিহাসে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে কৃষক প্রতিরোধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। বাংলার ইতিহাসে কৃষক বিদ্রোহ নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রাচীন কাল হতে প্রাক- ঔপনিবেশিক সময় পর্যন্ত বাংলায় নানা মাত্রায় এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপে কৃষক বিদ্ৰোহ আমরা লক্ষ করি। ১৭৬৩-১৯৪৯ খ্রি. বাংলায় সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহগুলো আকারে, গুরুত্বে ও বৈশিষ্ট্যে ছিল অনন্য সাধারণ। মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের পতন এবং মধ্য বিংশতিতম শতাব্দী পর্যন্ত এর স্থায়িত্ব বাংলায় সুদীর্ঘ বিদেশি শাসনের ইতিহাসে যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় ও যুগান্তকারী অধ্যায়। বাংলার জনগোষ্ঠীর তখন আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনা বলতে কিছু ছিল না। ফলে কে শাসক হলেন বা হলেন না তা নিয়ে জনগণের বিশেষ কোনো আগ্রহ বা উদ্বেগ ছিল না। নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য তাদের ছিল নিজস্ব জগৎ, যেখানে তারা থাকতো মোটামুটিভাবে স্বাধীন। তাদের এই স্বাধীন জগতের অপরিহার্য উপাদানগুলোকে যতদিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল রাখা হতো ততোদিন পর্যন্ত তারা কোনো প্রকার অসন্তোষ বা বিরাগ প্রকাশ না করে সরকারকে সাধ্যমতো কর প্রদানে প্রস্তুত থাকত। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে কোনো শাসকই স্থানীয় জনগণের নিজস্ব ধ্যানধারণা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ও প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকলে তা হতো মূলত কোনো মননশীল সংস্কারক বা রাজার আদেশ বলে । শাসকরা প্রধানত কর সংগ্রহ করেই তুষ্ট থাকতেন এবং তাদের অব্যাহত জীবন পদ্ধতি নিয়ে দেশ শাসন করতেন।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ১০৭ কিন্তু বিজেতা ও বিজিতের মধ্যে একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করার অলিখিত বিধানটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) ভেঙে পড়ে। বণিক সরকারের অত্যধিক মুনাফা-নীতি ও আর্থিক নিয়মনীতির কঠোর অনুশীলন ছিল এর ← জন্য দায়ী। বস্তুত বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম রাষ্ট্র গঠনে ও রাষ্ট্র চিন্তায় মুনাফার লক্ষ সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। ফলে নতুন শাসনের চাহিদা অনুসারে প্রধানত ভূমিব্যবস্থা, ব্যবসায় বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষা, আইন ও বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়। এই সকল পরিবর্তন ও সংস্কার প্রচলিত ব্যবস্থাকে নানাভাবে আঘাত করে। এতে সমাজে বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয় এবং এর থেকে তৈরি হয় শ্রেণিগুলোর মধ্যে বৈরিতা। সরকারের নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক ও কারিগরশ্রেণি । ফলে ঔপনিবেশিক সরকার এবং সরকার সৃষ্ট অন্যান্য আজ্ঞাবহ শ্রেণির বিরুদ্ধে বাংলার নানা স্থানে কৃষক ও কারিগরদের অসংখ্য বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এসব কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এ অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে ।
অবিভক্ত বাংলার কৃষক আন্দোলনের অনেক ইতিহাসই আজও পর্যন্ত অসম্পূর্ণ । এর অন্যতম কারণ হলো এই বিদ্রোহগুলো সংগঠিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যা ছিল একটি বিরাম প্রক্রিয়া। আপাতদৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া যেভাবে দৃষ্ট হয় ঠিক সেভাবে এর ইতিহাস তৈরি করা প্রায়শই কঠিন। কারণ স্থানীয়দের অসচেতনতার বিপরীতে ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে সংযুক্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের অবিরাম পক্ষপাতমূলক লেখনী বাংলায় একটি গোধূলি পর্যায় তৈরি করে যাতে ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির জয়গান। আর এরূপ পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনই হলো আমাদের স্থানীয় ইতিহাসের প্রধান উৎস। এ সকল উৎসের আলোকে বিচারবিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কৃষকের নৈর্ব্যক্তিক শ্রৈণিচরিত্র এবং শ্রেণি সম্পর্কের উপর তাদের বিদ্রোহ যেন ছিল শুধুমাত্র এ সম্পর্কের অনিবার্য এবং একমাত্র পরিণাম। ফলে এসব আলোচনায় বিদ্রোহীদের নিজস্ব ধ্যানধারণার কোনো পরিচয়ই প্রায় পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় বাংলার কৃষক বিদ্রোহের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুধাবনের প্রয়াসে আমরা বিদ্রোহী কৃষকদের চেতনা ও কর্মকাণ্ড বিভিন্ন রূপে বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দিতে চাই । অর্থাৎ বিদ্রোহী কৃষকদের মনোভঙ্গির সঠিক বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন হলো তাদের আর্থসামাজিক জীবন, সংস্কৃতির নানা দিক, ধর্ম বিশ্বাস এবং আরও নানা প্রশ্নের বিশ্লেষণ। বর্তমান আলোচনায় এ ধারণার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এই ধারণা মেনে নিলে বলতে পারি যে, বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো (১৭৬৩-১৯৪৯ খ্রি.) ঔপনিবেশিক সরকার, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আক্রোশের আকস্মিক প্রচেষ্টা মাত্র ছিল না, বরং বিদ্রোহগুলো ছিল বাংলার সংঘবদ্ধ কৃষকের সচেতন প্রতিরোধ শক্তির বহিপ্রকাশ। এই আলোকে আলোচিত বাংলার কৃষক প্রতিরোধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো ।
কৃষকের প্রতিরোধ শক্তির উদ্ভব ও বিকাশ
বাংলায় কোম্পানি সরকারের শাসনামলে (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) তাদের দায়িত্বহীন দুঃশাসন, শোষণমুখী রাজস্বনীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সম্পদ পাচার, দুর্ভিক্ষ এবং এদেশের কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন ইত্যাদি কারণে বাঙালি কৃষক সমাজ আপন অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিরোধ করে। বাঙালি কৃষক সমাজের জন্য কোম্পানির শাসন ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাঙালি কৃষক বিভিন্ন বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছিল। রনজিৎ গুহ (১৯৮২ খ্রি.) কৃষক শ্রেণির এ বোধকে কৃষক বিদ্রোহের সচেতনতা (Peasant Rebel's Awareness) বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো প্রথমে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে আরম্ভ হয় সন্দেহ নেই । কিন্তু শত্রু শক্তির মোকাবেলার কৌশলরূপে ক্রমশ তা সুসংগঠিত, স্বতঃস্ফূর্ত ও সংঘবদ্ধ আকার ধারণ করে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিদ্রোহগুলোর প্রসারতা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায়। ইংরেজ শাসনামলে আমাদের জানা মতে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহই ছিল প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৭৬৩-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। কিন্তু প্রথম দিকে এই বিদ্রোহের কোনো ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত নেতৃত্ব আমরা দেখি না। তবে সমগ্র বাংলা ও বিহারে এটি প্রসার লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে অন্যান্য সকল বিদ্রোহ যেমন, রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী চাকমা কৃষক বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.) রংপুর কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.) ময়মনসিংহের পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২০-১৮৩৩ খ্রি.) ওয়াহাবি বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৭ খ্রি.), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্রি.) নীলবিদ্রোহ (১৮৫৯- ৬০ খ্রি.) পাবনা বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩ খ্রি.), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬ খ্রি.) ও নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৯ খ্রি.) বহু জেলায় প্রসার লাভ করেছিল। কৃষক বিদ্রোহগুলোর এরূপ ক্রম প্রসারতার মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষকদের সংগ্রামী চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
বিদ্রোহসমূহের সময়ম্বয়বাদিতা ও একাগ্রতা
বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল মূলত একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ হতে শোষণ-উৎপীড়নে ক্ষিপ্ত কৃষক যে সকল দাবি নিয়ে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল তা ছিল প্রায় সকল বিদ্রোহের মূল দাবি ও ধ্বনি। বিদেশি ইংরেজ শাসন হতে মুক্তি, রাজস্ব আদায়ে পরগনা নিরিখ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি, আবওয়াব রহিতকরণ, প্রচলিত খাজনার হার অগ্রাহ্য এবং কৃষকশ্রম শোষণ বন্ধ এগুলো প্রতিটি বিদ্রোহের মূল দাবি। এই লক্ষ্য অর্জনে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রতিটি বিদ্রোহের বক্তব্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন উৎখাত করে সনাতন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কেননা সে শাসনাধীনে কৃষকদের নিকট হতে ন্যায্য খাজনা আদায় করা হতো এবং প্রয়োজনে ঋণ দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করা হতো। এধরনের দাবির প্রেক্ষিতে সংগঠিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কৃষক বিদ্রোহকে জেমস সি. স্কট (James C. Scott, 1976) কৃষক সমাজের নৈতিকতার প্রশ্নের বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এই শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ঔপনিবেশিক বার্মা ও ভিয়েতনামের দুটি কৃষক বিদ্রোহ

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে কৃষক প্রতিরোধ আন্দোলনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ১০৯ পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এছাড়া ঔপনিবেশিক বাংলার বিভিন্ন বিদ্রোহের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকলেও এই বিদ্রোহগুলোকে সম্পর্কহীন বলা যাবে না। কেননা প্রতিটি বিদ্রোহই পূর্ববর্তী বিদ্রোহ হতে অধিকতর সংগঠিত রূপে এবং অধিকতর বিস্তৃত আকারে প্রসার লাভ করেছিল। প্রতিটি বিদ্রোহই যেন এর বহুমুখী প্রতিভা ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী বিদ্রোহের সংগ্রামী কৃষকের নিকট হস্তান্তরিত করেছে। এক্ষেত্রে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য যে, গণসংগ্রামের কোনো অভিজ্ঞতা, কোনো শিক্ষাই ব্যর্থ হয় না। বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তাদের এই মন্তব্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এবং ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহে কৃষক সমাজ যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংহতি প্রকাশ করেছিল আমরা ১৮৩৮-৪৭ খ্রি. ফরায়েজি বিদ্রোহ ও ১৮৫৫-৫৬ খ্রি. সাঁওতাল বিদ্রোহে-এর প্রভাব লক্ষ করি। সুতরাং এই অর্থে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহগুলোকে ‘রাজনৈতিক বিপ্লব' বলে অভিহিত করা যায়।
আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রাম
আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা ছিল এ যুগের কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি. মধ্যে সংগঠিত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩- ১৮০০ খ্রি.), শমসের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮ খ্রি.), রংপুরের কৃষক বিদ্ৰোহ (১৭৮৩ খ্রি.), প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.), তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহে (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) এক প্রকার আপসহীনতার বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছিল। এ সকল বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কৃষক প্রজা এবং তাদের নেতারা কোনোভাবে আত্মসমর্পণ না করে মৃত্যু অবধি যুদ্ধ করেছেন। এতে আপসহীনতার বৈশিষ্ট্যই প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে আপসহীন সংগ্রামের পরবর্তী আদর্শ কোম্পানি শাসনাধীন বিদ্রোহী কৃষকদের অন্যতম অবদান। এই সকল বিদ্রোহের প্রত্যেকটিই সর্বাত্মক ধ্বংস ও পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে অগনিত সংখ্যায় কৃষক ও কারিগরশ্রেণি, শমসের গাজীর বিদ্রোহে সকল কৃষক বাহিনী নির্ভয়ে কামানের গোলায় আত্মাহুতি দিয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহে পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে প্রায় পঁচিশ হাজার যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। কিন্তু তারা আপস বা আত্মসমর্পণ করেনি। অথচ বিদ্রোহী কৃষকদের আত্মসমর্পণের বা সরকারের সাথে আপসের যথেষ্ট সুযোগ ছিল। তবে এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, বিদ্রোহী কৃষকরা দেশাত্মকবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল। তারা প্রধানত তাদের নেতাদের প্রতি আনুগত্য, সনাতন ব্যবস্থা ফিরে পাওয়া এবং নিজেদের আর্থসামাজিক জীবনকে বিদেশি শাসকের কবলমুক্ত করতে চেয়েছিল। এ ধরনের বিদ্রোহ রাষ্ট্র কর্তৃক কৃষকদের বা প্রজা সাধারণের উপেক্ষিত হবার বোধ পুনঃপ্রবর্তন তৈরি হয়। বাংলার কৃষক বিদ্রোহীদের এই আপসহীনতা এ কারণেই আরও বেশি স্মরণযোগ্য যে, তারা যখন এরূপ সংগ্রামে আত্মনিবেদন করছেন তখন একশ্রেণির এদেশীয় জমিদার-তালুকদার ও মধ্যবিত্তশ্রেণি নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে আপসের আদর্শ স্থাপনে ব্যস্ত থেকেছেন। ফলে এই দুই আদর্শের বিচারে কৃষক-প্রজার আদর্শই ছিল যে কোনো বিচারে মহৎ ও সর্বাধিক প্রশংসাযোগ্য।
আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা
ঔপনিবেশিক সরকারের শাসন ও শোষণ মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস- বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলোতে লক্ষ করা যায়। যদিও এটি ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তথাপিও ত্রিপুরার শমসের গাজীর বিদ্রোহ, সন্দ্বীপ বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ, প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ, ওয়াহাবি বিদ্রোহ, ফরায়েজি বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল এই বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এ সকল বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কৃষক সম্প্রদায় নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিল যে, ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর শোষণ পুনঃপ্রবর্তন মুক্ত হতে না পারলে নিজেদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। আর এই মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। উদাহারণস্বরূপ বলা যায় যে, শমসের গাজীর বিদ্রোহে ত্রিপুরা রাজ্যের শক্তি ধ্বংস করে তিনি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সন্দ্বীপে আবু তোরাব সরকারকে কর প্রদান বন্ধ রেখে স্বাধীন জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। চোয়াড় বিদ্রোহীরা মেদিনীপুরের নব্য জমিদার ও ইজারাদারদেকে তাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন রাজ্যের ঘোষণা দেন । পাগলপন্থি বিদ্রোহে টিপু শাহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী কৃষক শ্রেণি সুশং এর জমিদার পরিবারকে বিতাড়িত করে স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে। বাংলার তিতুমীরের বিদ্রোহে তাঁর ‘বাদশাহ' উপাধি ধারণ স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত প্রদান করে। সে সাথে তিতুমীরের নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে আদালত স্থাপন তার স্বাধীনতাকে নিশ্চিতকরণের প্রয়াস বলেই মনে হয়। একই উদ্দেশ্যে নিজের স্বাধীনতার প্রতীক স্বরূপ তিনি নারকেলবাড়িয়াতে বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ফরায়েজি বিদ্রোহেও একপ্রকার রাজনৈতিক অভিলাষ বিদ্যমান ছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহ কর্তৃক ইংরেজ অধিকৃত রাষ্ট্রকে ‘দারুল হরব’ বা শত্রু রাষ্ট্র ঘোষণা একপ্রকার রাজনৈতিক দর্শনের স্পষ্ট আভাস। তাছাড়া দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জমিদার-মহাজনদের উপর করারোপ, প্রজার কর বিলোপ, গ্রামে গ্রামে আদালত গঠন ও বিচার পরিচালনা তার বিদ্রোহের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দেয়। আর ১৮৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য স্থাপন। কেননা দিকু বা অসাঁওতালদের নিকট হতে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির আশা তারা ছেড়ে দিয়েছিল। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন সিদুর স্বাক্ষরিত পত্র দ্বারা সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি, জমিদার-মহাজনকে তাদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয় । ফলে বাংলার কতিপয় কৃষক বিদ্রোহে স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল ।
৩.৫ অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণআন্দোলন
বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয় । প্ৰাক- ঔপনিবেশিক যুগে বাংলার কৃষকরা ছিল ঐতিহ্যগতভাবে প্রায় স্বাধীন। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠন কৃষকদের সেই স্বাধীন সত্তাকে বিনষ্ট করে দেয়। ফলে কৃষকরা দারুণভাবে হতাশ হয়। এ হতাশা থেকে বিদ্রোহের তীব্রতা অনেকটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন মানদণ্ডে গ্রামীণ মানুষের বিদ্রোহী ক্রিয়াকাণ্ড যাচাই করা হয়। অনেক লেখক চার

পরিমাপকের উপর জোর দেন যেমন, সংগঠন, পরিকল্পনা, সমাবেশ ও মতাদর্শ। এ চারটি পরিমাপকের বিচারে বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সংগঠন গঠনে এই বিদ্রোহগুলো ছিল রনজিৎ গুহের (Ranajit Guha) জন বিদ্ৰোহ তত্ত্বের কাছাকাছি। তার মতে, বিশেষ অভিযোগ এ দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য জনগণ প্রয়োজনে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তবে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের বিশেষ দিক হলো এর চালিকাশক্তি হবে কৃষক এবং একক কোনো কেরামতি ক্ষমতাসম্পন্ন ধৰ্মীয় নেতা এটা নিয়ন্ত্রণ করে না। রংপুর বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ ও ময়মনসিংহ বিদ্রোহ থেকে বুঝা যায় যে, বিদ্রোহগুলোর প্রকৃত নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় নেতাগণ। বিদ্রোহের নির্দেশ আসত বহু কেন্দ্র হতে। কিন্তু সংগঠনের মূল শক্তি ছিল কৃষক। শত্রুর মোকাবিলায় কৃষকরাই সবসময় এগিয়ে এসেছে।
এই সকল বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। বিদ্রোহীদের দাবি ছিল তাদের উৎপাদনের উপর বহিরাগতদের দাবি হ্রাস করা এবং অত্যাচার নিপীড়ন বন্ধ করা। এ অবস্থায় সরকার সাড়া না দিলে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা অত্যাচারী ও অতিরিক্ত কর আদায়কারীর উপর হতে আনুগত্য প্রত্যাহার করে এমন একজনের নিকট তা অর্পণ করে, যিনি ছিলেন বিশ্বস্ত এবং যুক্তিসংগত হারে কর সংগ্রহের পক্ষপাতী। এই সকল বিদ্রোহের মতাদর্শে ছিল কিছু স্বপ্ন। বিদ্রোহে অংগ্রহণকারীরা ছিলেন সব ধর্মের ও বর্ণের। বিদ্রোহীদের সামাজিক পরিচয় ছিল এরা উপজাতীয়, নানা উপবর্ণের হিন্দু ও নানা পেশার মুসলমান। তারা গোষ্ঠী পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর হলেও সকলের যোগাযোগের ভাষা ছিল বাংলা। তাদের ধর্ম ও বর্ণ ভেদ কখনো সংগ্রামে কোনো ইস্যু তৈরি করেনি। তাদের বিদ্রোহের মতাদর্শ ছিল মূলত উৎপাদন সম্পর্কে ও শোষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিদ্রোহীরা সামাজিকভাবে মোটামুটি অভিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষক ছিল বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা খাজনার হার হ্রাস, অবৈধ কর ও বেগার প্রথার বিলোপ প্রভৃতি ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণিরই দাবি। এই সকল দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পুষ্ট জমিদারদের শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে এক প্রকার গণআন্দোলন হিসেবে সংগঠিত I

প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শ্রেণিসমূহের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য


১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজ সরকার বাংলার প্রাচীন গ্রাম- সমাজের কাঠামো ভেঙে দিয়ে কৃষক সমাজকে মুক্তি দেয় বটে কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে ব্রিটেনের অনুকরণে নতুন এক সামন্ত প্রথার বন্ধনে কৃষককে বেঁধে ফেলে । এর ধারাবাহিকতায় সরকার ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উপনীত হয়। ফলে বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক পরিবর্তন ঘটে। স্বাধীন কৃষকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, প্রাক্তন জমিদারশ্রেণি অধিকারচ্যুত হয়। সে সাথে আরও কিছু মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে কৃষক, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ইংরেজ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয় এবং ত্রিশক্তি আঁতাত গঠন করে। এক্ষেত্রে আমরা মেদিনীপুরের চোয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-৯৯ খ্রি.) প্রসঙ্গ টেনে আলোচনা শুরু করতে পারি। এই বিদ্রোহের প্রথম শক্তি ছিল কৃষক। বাংলার দরিদ্র ও আদিবাসী কৃষক জীবন ধারণের মৌলিক

সমস্যায় জর্জরিত হয়ে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই বিদ্রোহের মূলশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাতে ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা ও নিজস্বতার তাগিদ। দ্বিতীয়ত; এই বিদ্রোহে কৃষকদের পক্ষে অংশগ্রহণকারী একটি শ্রেণি ছিল পাইক সম্প্রদায়। তারা ছিল মধ্যস্বত্বভোগী। তারা জমিদারের অধীনে স্থানীয় শান্তি রক্ষার কাজ করতো এবং নগদ বেতনের পরিবর্তে নিষ্কর জমি ভোগ করতো। এরূপ জমিকে পাইকান বলা হতো। কিন্তু ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বন্দোবস্তের ফলে এই পাই সম্প্রদায়ের স্থলে পুলিশ বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়। ফলশ্রুতিতে পাইকরা কর্মচ্যুতি ও ভূমিহীনে পরিণত হয়। অর্থ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে একটি পৃথক মর্যাদার স্থানও তাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ঔপনিবেশিক শাসন এই উভয় ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে এই উভয়বিধ অবস্থানে প্রত্যাবর্তনের তাগিদে তারা ঔপনিবেশিকতা বিরোধী কৃষক বিদ্রোহে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে। তৃতীয়ত; দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের এই কৃষক বিদ্রোহে পতিত জমিদারশ্রেণির একটি অংশও নিজস্ব শ্রেণি স্বার্থেই সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। কেননা ইংরেজ শাসনের রোষানলে পড়ে তারা জমিদারি ও সামাজিক মান- মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তাদের জমিদারিগুলো চড়াদামে কিনে নেন নব্য জমিদারশ্রেণি। এমতাবস্থায় প্রাক্তন জমিদারশ্রেণির পক্ষে সার্বিভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে, নব্য জমিদারশ্রেণিটিকে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না চরিত্রগত কারণেই। আর্থিক অবস্থার অবনতি এবং সামাজিক মর্যাদার আশা তাদেরকে হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সক্রিয় করে তোলে। যে কারণে তাদের অনেকে কৃষকবিদ্রোহে নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনা দিতে এগিয়ে আসেন ।
এই তিনটি শ্রেণিই (কৃষক, পাইক ও পতিত জমিদার) ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের দ্বারা পরিচালিত হলেও, ঔপনিবেশিকতা বিরোধী মূলস্রোত একত্রিত হতে কোনো বাধা ছিল না। কেননা সকলের শত্রু ছিল এক অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি। অন্যদিকে শাসকশ্রেণি তার ঔপনিবেশ ও রাষ্ট্র কাঠামোর উপর দখল সুদৃঢ় রাখার কারণেই বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। কেননা বিদ্রোহের সাফল্য নবগঠিত সাম্রাজ্যের পতনকেই ত্বরান্বিত করতো, যা শাসকশ্রেণির কাম্য ছিল না। অনুগত নব্য জমিদারবর্গ ঔপনিবেশিক শাসনেরই সৃষ্ট ফল। তাই তাদের অস্তিত্বও ঔপনিবেশিক শক্তির সাথেই বন্ধনযুক্ত ছিল। বস্তুত ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভিন্নধর্মী শ্রেণিগুলো একত্রিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এই বিভিন্নতার দরুনই তাদের পতনও ছিল অবশ্যম্ভাবী। কেননা সর্বহারা আদিবাসী কৃষকের স্বার্থ এবং পাইক ও পতিত জমিদারের স্বার্থ এক ছিল না। তাই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শাসকশ্রেণির প্রতিশ্রুত সুবিধা লাভের বিনিময়ে জমিদার ও পাইক সম্প্রদায় বিদ্রোহী কৃষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের সাথে হাত মেলায়। জমিদার ও পাইকশ্রেণির এরূপ বিশ্বাসঘাতকতা এক ঐতিহাসিক সত্যেরই প্রতিফলন মাত্র। কেননা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে, প্রত্যেকটি অগ্রবর্তী শ্রেণিই নিজস্ব অবস্থানকে সুদৃঢ় করার প্রয়াসে, পশ্চাৎপদ অংশকে স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে থাকে। পাশাপাশি বাংলার বিদ্রোহগুলোতে শ্রেণিগত গঠন-কাঠামোর তারতম্যতায়, একই শোষণের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শক্তিগুলোর সীমাবদ্ধতার দিকটিও প্রকাশ পায় । বাংলার চাকমা বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ ও পাগলপন্থি বিদ্ৰোহ এই বৈশিষ্ট্যের অনুশীলন বলে প্রমাণিত হয়।
প্রতিরোধীদের সুপ্ত শ্রেণিচেতনা
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন আন্দোলনে বিশেষত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, পাগলপন্থি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, ফরায়েজি বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মীয় অনুভূতি কিছুটা কার্যকর শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ত্রিপুরার শমসের গাজীর বিদ্রোহ, সন্দ্বীপ বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, মালঙ্গীদের সংগ্রাম, রংপুর কৃষক বিদ্রোহ ও চোয়াড় বিদ্রোহে ধর্মের বিশেষ কোনো ভূমিকা আমরা দেখি না। এই সকল বিদ্রোহে কৃষকগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সহজাত প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে নরহরি কবিরাজ-এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য
, "In fact the village people participated in the revolt irrespective of their caste, community and Creed Neither caste distinction nor communal differences obstructed the march of events." এই বক্তব্যে নরহরি কবিরাজ রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে একটা শ্রেণিসংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে জাতি ও সম্প্রদায়ের পৃথক কোনো ভূমিকা ছিল না। বাংলার অন্যান্য বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও এই বক্তব্য প্রযোজ্য। বিখ্যাত নিম্নবর্গ গবেষক রণজিৎ গুহও কৃষক বিদ্রোহীদের তৎপরতায় শ্রেণিচেতনার বিদ্যমানতা স্বীকার করে নিয়েছেন। বাংলার কৃষক বিদ্রোহে জমিদারদের অংশগ্রহণ এবং অন্যান্য শ্রেণির নেতৃত্ব প্রদান মূলত কৃষকদের সাথে অভিন্ন স্বার্থকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যদিও জমিদার- মধ্যস্বত্বভোগী ও কৃষক অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণি দু'টির শক্তি ও স্বার্থ এক নয়। কিন্তু ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপ বিদ্রোহ ও ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহে এই শ্রেণি দু'টির ঐক্য হয়েছিল ইজারাদারদের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে। শোষক ও শোষিতের প্রশ্নে কৃষক সম্প্রদায়কে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে ইজারাদার বিরোধী প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পথ খুঁজে পান জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্দ্বীপ ও রংপুরের বিদ্রোহকে শ্রেণিসংগ্রাম বলা চলে। তবে সম্পূর্ণভাবে বর্তমান কালের চেতনায় নয় বরং অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার সীমিত গণ্ডিতে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বার্থবাদী ও নিপীড়িত শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ চেতনার বিচারে প্রতিরোদের সুপ্ত শ্রেণিচেতনার প্রতিফলিত হয় ।
প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্বের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস
বাংলার কৃষক বিদ্রোহীদের মানসিকতার উৎস ছিল বহুমুখী। এর মধ্যে একটি ছিল গোত্রীয় নেতৃত্বের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি অকৃত্রিম আস্থা। বাংলার কয়েকটি কৃষক বিদ্রোহে এই বৈশিষ্ট্য ছিল লক্ষণীয় বিষয়। এ শ্রেণির বিদ্রোহগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৫-৩৩ খ্রি.), তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.), ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৭ খ্রি.) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি । এই বিদ্রোহগুলোর মধ্যে তিতুমীরের বিদ্রোহ ও ফরায়েজি বিদ্রোহ প্রথমে তথাকথিত ধর্মসংস্কারের নামে শুরু হয়ে পড়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করে এবং জমিদার, নীলকর ও মহাজন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের শক্তিশালী প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। আর পাগলপন্থি বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠনে ধর্মের ভূমিকা ছিল লক্ষণীয় বিষয়। ‘ধর্ম' কথাটি দ্বারা আমরা এখানে কৃষক বিদ্রোহের নেতাদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় অনুসারীদের যুক্তিহীন বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছি। এরূপ ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি, নানারূপ বিকাশ ও রূপান্তর ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। একটা বিষয়ে নানা ব্যাখ্যায় মোটামুটি মিল আছে। আর তা হলো ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রে আছে অতিপ্রাকৃত অলৌকিক কোনো শক্তির ধারণা, যে শক্তি মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এমনকি তার চিন্তাধারাকে নির্ধারিত করে। ‘আল্লাহ' (সৃষ্টিকর্তা) বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সঙ্গে এ বিশ্বাসও যুক্ত হয় যে, আল্লাহর শক্তি মানুষের ধারণা বহির্ভূত। আল্লাহর ঐশ্বর্য কোনো কোনো মানুষে আরোপিত হতে পারে। কিন্তু সেখানেও মূল বিশ্বাস, সে মানুষ বিশেষ একজন। মানুষের প্রয়োজনে ধর্মের সৃষ্টি, তাই লৌকিক পরিবেশের ভিন্নতায় এ বিশ্বাসের রূপও পাল্টায়। এ বিশে৷ অর্থে কৃষক বিদ্রোহে ধর্মচেতনার বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে এর কয়েকটা বিশেষ দিক প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই। আগেই বলেছি, বিদ্রোহী কৃষকদের মানসিকতার 'উৎস বহুমুখী। অন্যান্য অনেক প্রভাবের সঙ্গে ধর্মচেতনাও নানাভাবে মিশে থাকে। যে ধর্ম বিশ্বাস কৃষক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে, বহু ক্ষেত্রে তা কৃষকদের পুরনো ধর্মবিশ্বাস থেকে স্বতন্ত্র। পুরানো ধর্ম বিশ্বাস যদি থাকেও বা, তার অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ধর্মচেতনার বিশিষ্ট ভূমিকা আন্দোলনের সকল পর্যায়ে সমান থাকেনি। সাধারণত এ ভূমিকা তখনই স্পষ্টভাবে দেখা যাবে যখন বিদ্রোহী কৃষককেরা চলমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সম্পূর্ণভাবে আস্থা হারিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার আমূল পুনর্বিন্যাসের কথা ভেবেছে। কারণ তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এছাড়া 'প্রভু' শ্রেণির (শাসকশ্রেণি) কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ ধর্মচেতনার ভূমিকা এক বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। এতে প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্বের আলৌকিক ক্ষমতায় আস্থা প্রমাণিত হয় ৷
ধর্মের প্রভাবের দিক থেকে বিচার করলে দু'ধরনের আন্দোলন দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ প্রভাব একান্তই সীমিত। এখানে ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব প্রধানত আন্দোলনের সংহতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বাংলার ফরায়েজি আন্দোলনে এ বৈশিষ্ট্য প্রকটরূপে লক্ষ করা যায়। আর দ্বিতীয় ধরনের আন্দোলনে এ প্রভাব ছিল অনেক সুদূরপ্রসারী এবং গভীর। এখানে বিদ্রোহের যৌথ সিদ্ধান্ত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। বিদ্রোহী সংগঠনের মূল শক্তি ও ধর্ম প্রভাবিত কোনো কোনো বিশ্বাস দ্বারা তৈরি হয়। আর নেতার প্রতি অবিচল আনুগত্যের একটা প্রধান উৎস ধর্মীয় ধারণা প্রসূত। আন্দোলনের উপায় এবং লক্ষেও থাকে ধর্মবিশ্বাসের গভীর প্রভাব। ময়মনসিংহের প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.)-এর অন্যতম প্রমাণ। তবে ধর্মবোধ মোটেই অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ধারণাও পাল্টে গেছে। প্রথম পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩ খ্রি.), তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫- ৫৬ খ্রি.) শ্রেণির উদাহরণ। এই তিনটি আন্দোলনে ধর্মের ভিত্তিতে আমূল রাজনৈতিক রূপান্তর সাধনের প্রয়াস ছিল বিদ্রোহের মূল প্রেরণা। এ সকল আন্দোলনে ধর্মবিশ্বাসের তাৎপর্য শুধুমাত্র বিদ্রোহীদের সংহতিবোধের প্রধান ভিত্তিই ছিল না বরং বিদ্রোহের মূল লক্ষ, লক্ষসিদ্ধির উপায় এবং বিদ্রোহের সংগঠন ইত্যাদি সম্পর্কে কৃষকদের নানা ধারণাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

ফরায়েজি আন্দোলন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ধর্মের ভূমিকা এখানে অপেক্ষাকৃত সীমিত। তবে নেতার নির্দেশকে ফরায়েজিরা জমিদারি কর্তৃত্বের বিকল্প হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল। সে তুলনায় পাগলপন্থি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি ব্যাপক। ফরায়েজিদের মতো নতুন ধর্মবিশ্বাসে দীক্ষিত ওয়াহাবি কৃষকরাও জমিদারি কর্তৃত্বের কোনো কোনো দিক মেনে নেয়নি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা আরও বিশিষ্ট রূপে দেখা দিয়েছিল। কেননা ওয়াহাবিদের রাজ-বিরোধী ধারণা, স্বর্গ লাভের প্রেরণা, তিতুমীরের অলৌকিক ক্ষমতায় শত্রুর পরাভব ঘটবে এবং সুফি ও পীর ঐতিহ্য স্বীকার করে ফকির মিশকীন শাহের সাথে তিতুমীরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি বিষয়াবলি বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্যে নতুন দিক নির্দেশ করে। পাগলপন্থিদের ক্ষেত্রে ধর্ম গুরুর এ অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাসের প্রভাব ছিল আরও গভীর। ওয়াহাবিদের মতো তাদেরও যথাসাধ্য সামরিক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তাদের নৈতিক এবং আত্মিক শক্তির উৎস ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। তাদেরও বিশ্বাস ছিল যে, তাদের নেতা টিপু শাহ ও তার মার (মা সাহেবা) মধ্যে অতিপ্রাকৃত শক্তি মূর্ত হয়েছে। এ শক্তির প্রভাবে শত্রুশক্তি যত শক্তিশালীই হোক যুদ্ধে পরাভূত হতে বাধ্য ।
নেতার এ শক্তির উৎস একপ্রকার জাদুশক্তি। বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে বলেছে, পাগলরাজ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ তারা মানবে না। কারণ টিপু শাহ অন্যের নির্দেশ মানতে তাদের বারণ করেছে। অর্থাৎ বিদ্রোহের ঘোষণা, সংগঠন এবং বিদ্রোহীদের সব কাজকর্ম ধর্মগুরুর নির্দেশে পরিকল্পিত ও বাস্তবায়িত হতো। অথচ ডব্লিউ ভিলেম শেন্ডেল (W. V. Schendel, 1985) -এ আন্দোলনে ধর্মের ভূমিকা স্বীকার করতে রাজি নন। এক্ষেত্রে এ আন্দোলন সম্পর্কে স্টিফেন ফুকসের (Stephen Fuchs 1965) সিদ্ধান্তও মানেননি। ফুকস মনে করেন যে, এ আন্দোলন সর্বতোভাবে দিব্য শক্তি নির্ভর ছিল ।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহে ব্যাপক প্রভাব ছিল সুবা ঠাকুরের (দেবতা) আবির্ভাবের ঘটনা। এই সুবা ঠাকুরই তাদের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছে। আরও বলা হয় যে, ঠাকুর নিজেই যুদ্ধ করবেন। অতএব ‘হুল' (বিদ্রোহ) দিব্য শক্তি নির্দেশিত ।
তাই সাঁওতালদের জয় অনিবার্য। এই ধর্মীয় বিশ্বাস অল্প সময়ের মধ্যে গোটা সাঁওতাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহের মূল প্রেরণা এবং সংগঠনের প্রাণশক্তি ছিল এ বিশ্বাস। এজন্য রণজিৎ গুহ বলেছেন যে, ধর্মচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ‘হুল’ বোধগম্য হবে না। সুতরাং পাগলপন্থি বিদ্রোহ (১৮২৪-৩৩), ওয়াহাবি বিদ্রোহ (১৮৩১), ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৭) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬) ধর্মের প্রভাবের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় আর তা হলো, বিদ্রোহীদের একক বিশ্বাস যে, অসাধারণ আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে এমন এক সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেখানে থাকবেনা কোনো প্রকার শোষণ-নির্যাতন এবং এক শ্রেণির উপর অন্য শ্রেণির কর্তৃত্ববাদ। এই নতুন ব্যবস্থা ছিল বিদ্রোহীদের কাছে পরিপূর্ণ সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতীক। ফলে আন্দোলনের নেতাদেরকে তারা পরিত্রাতা বলে মনে করেছে।

সামন্ততান্ত্রিক মধ্য যুগে ধর্মের এই সংগ্রামী ভূমিকা ইউরোপেরও সর্বত্র লক্ষ করা যায় । এমনকি সেই যুগে ইউরোপেও এরূপ ধর্মসংস্কারকে নির্ভর করে অনেক কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। এ ধরনের আন্দোলনকে ইউরোপে Millenarian (ধর্মীয় নেতৃত্বের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী) বলা হতো। ‘পরিত্রাতা'-নেতার বিশিষ্ট্য ভূমিকার জন্য কেউ কেউ একে Messianic (ভাবী মুক্তিদাতার নেতৃত্বে বিশ্বাসী) আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। যদিও সব Millenarian আন্দোলন বিশেষ অর্থে Messianic নয়। এখন এটি সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত যে, বাংলার ধর্মাশ্রয়ী কৃষক বিদ্রোহগুলো যেমন- ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, পাগলপন্থি বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, ফরায়েজি বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রথমে ধর্মের আহ্বানে শুরু হলেও ক্রমশ তা দেশব্যাপী গণসংগ্রামের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গণসংগ্রামের ধর্মের প্রভাবও ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে । বাংলার ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছিল।
বাংলার কৃষক বিদ্রোহের আঞ্চলিকতা
বাংলার কৃষক বিদ্রোহসমূহের (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রি.) অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর আঞ্চলিক চরিত্র। ১৭৬৩-১৮০০ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে ১৮৫৫-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহ পর্যন্ত প্রতিটি বিদ্রোহই বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠিত রংপুর বিদ্রোহের ব্যপ্তি ছিল শুধুমাত্র বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের পূর্বাংশ নিয়ে। এর বাইরে এই বিদ্রোহ বিস্তৃত হয়নি। ইছামতি নদীর দু'ধারে ১৮/২০ মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর ফরায়েজি বিদ্রোহ-প্রবণ এলাকা ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরসহ ঢাকা, বাখেরগঞ্জ ও যশোর জেলার কতিপয় অঞ্চল। এতে স্পষ্ট হচ্ছে যে, কৃষক বিদ্রোহগুলো আঞ্চলিক সীমা অতিক্রম করে বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। বস্তুত বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো মূলত সরকার, জমিদার ও তালুকদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। যে সকল জমিদার ও তালুকদার পরগনা নিরিখ না মেনে অতিরিক্ত রাজস্ব ধার্য করতেন এবং যারা কৃষকের নিকট হতে নানা প্রকার অবৈধ কর আদায় করতেন সে সকল স্থানেই প্রধানত বিদ্রোহ হয়েছে বেশি। অন্যত্র তেমন বিদ্রোহ হয়নি। দ্বিতীয়ত; বিদ্রোহগুলোর আঞ্চলিক রূপ ত্যাগ করে সর্বময় চরিত্র ধারণ করার জন্য যে একক বা যৌথ নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল তা কৃষকদের মধ্য হতে তৈরি হয়নি। তৃতীয়ত; বাংলার বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন যেমন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে মজনুশাহ, ত্রিপুরার বিদ্রোহে শমসের গাজী, সন্দ্বীপ বিদ্রোহে আবু তোরাব চৌধুরী, রংপুর বিদ্রোহে নূরলদীন ও দয়াশীল, চোয়াড় বিদ্রোহে দুর্জন সিং, পাগলপন্থি বিদ্রোহে টিপু শাহ, ফরায়েজি বিদ্রোহে হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়া এবং সাঁওতাল বিদ্রোহে সিঁদু-কানু- তাদের সকলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ একই রকম ছিল না। চতুর্থত; বাংলার কৃষক বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা কেউ কৃষক ছিলেন না। সামাজিক পরিচয়ে তারা সকলেই ছিলেন উঁচুশ্রেণির বাসিন্দা। ফলে সরকার প্রদত্ত কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি বা ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির প্রশ্নে তারা বিদ্রোহী অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এমন উদাহরণ অনেক। পঞ্চমত; বিদ্রোহসূহে নেতার মৃত্যু হলে বা তিনি কোনো কারণে আহত হলে তার স্থলে বিকল্প নেতৃত্ব দিয়ে সে স্থান পূরণের উদ্যোগ অনেক বিদ্রোহেই আমরা দেখি না। ষষ্ঠত; বাংলার কৃষক শ্রেণি অন্য কোনো শ্রেণির (যেমন শ্রমিকশ্রেণি) মতো একটি সংগঠিত শ্রেণি ছিল না। তারা ছিল বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত একটি শ্রমজীবী সম্প্রদায়। কৃষকদের স্তরভেদের কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল বহুমুখী যা তাদের মধ্যে কোনো প্রকার শ্রেণিসুলভ ঐক্যবোধের বিকাশ ঘটায়নি। ফলে এক অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহে অন্য অঞ্চলের বা পাশাপাশি অঞ্চলের কৃষকরা সাহায্য ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এমতাবস্থায় বাংলার কৃষক বিদ্রোহগুলো জাতীয় কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে না পেরে আঞ্চলিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে প্রতিরোধ আন্দোলনে যে নেতৃত্বের অলৌকিক ক্ষমতায় আস্থা ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।
স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা
বাংলার যেখানে মুদ্রা অর্থনীতি চালু ছিল সেখানে পরগনা নিরিখ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল কৃষক বিদ্রোহের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলার সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে (পাহাড়- পর্বতময় স্থানে) মুদ্রা অর্থনীতির তেমন প্রচলন ছিল না। সেখানকার কৃষি কৌশল ছিল লাঙলপূর্ব যুগের জুমচাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঔপনিবেশিক সরকার সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও আদিবাসী এলাকাসমূহে নিজ স্বার্থে মুদ্রা অর্থনীতির প্রবর্তন ঘটায়। এ নিরিখে তারা ভূমিতে মধ্যস্বত্ব ও নতুন ইজারাদারশ্রেণি সৃষ্টি করে। তারা আদিবাসী চাষিদের বাধ্য করে নগদ অর্থে রাজস্ব প্রদানের জন্য। কিন্তু এই নতুন প্রবর্তিত ব্যবস্থার সাথে আদিবাসী কৃষকদের কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। এ ব্যবস্থা ছিল তাদের নিকট সম্পূর্ণ নতুন এবং অনেকাংশে অসহনীয়। স্বাভাবিক কারণেই আদিবাসীরা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করে। আদিবাসী বিদ্রোহগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেদিনীপুরের চোয়াড় বিদ্রোহ (১৭৭০-১৮০০ খ্রি.), পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্ৰোহ (১৭৭৬-৮৭ খ্রি.) ও সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) ইত্যাদি। এসব আদিবাসী বিদ্রোহের লক্ষ ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করে প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বজায় রাখা, যা তারা যুগ-যুগ ধরে ভোগ করে আসছে। স্বাধীকারের প্রশ্নে আদিবাসীরা ছিল আপসহীন। কারণ এটি ছিল তাদের জন্মগত সম্পদ। যে কারণে ইংরেজ আক্রমণের শতভাগ সম্ভাবনা জেনেও তারা ইংরেজদেরকে কর প্রদান বন্ধ রাখে। সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধিদেরকে তাড়িয়ে দেয় বা স্থান বিশেষে হত্যা করে। আর আদিবাসী সমাজগুলোর নিকট রাষ্ট্রের আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে নেওয়া ছিল এক অজানা অভিজ্ঞতা এবং স্পষ্টত তারা এ জাতীয় বশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে । কোনো কোনো ইংরেজ কর্মচারী এই আদিবাসীদের স্বাধীনতা প্রিয়তার মুগ্ধ হয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণের জন্যও সরকারের নিকট আবেদন পেশ করেছিলেন বলে জানা যায়। সুতরাং নিজস্ব স্বাধীন অঞ্চল গঠনের স্বপ্ন আদিবাসীদের প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করেছে সংগ্রামে। বাংলার আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহগুলো প্রমাণ করে যে, তারা রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল। বিদ্রোহীদের অনমনীয় মনোভাবের কারণে অবশেষে সরকার চাকমা ও সাঁওতাল আদিবাসীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এভাবে তাদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সফল হয় ।
প্রতিরোধ আন্দোলনের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ
বাংলার কৃষক বিদ্রোহের (১৭৬৩-১৯৪৯ খ্রি.) একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর রাজনৈতিক চেতনা প্রসঙ্গ। তবে এতদবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। ইদানিং দক্ষিণ এশিয়ার কৃষক-বিদ্রোহ গবেষণায় প্রশ্ন উঠেছে যে, প্রাক-ধনতান্ত্রিক যুগের কৃষক বিদ্রোহগুলো আদৌ রাজনৈতিক ছিল কিনা। এ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন অধ্যাপক ই.জে. হবসবম (E.J. Hobsbawm, 1959)। তার মতে, যে সমাজ সম্পূর্ণভাবে শিল্পয়িত হয়নি সে সমাজের কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল মূলত প্রাক-রাজনৈতিক । তিনি তার গবেষণায় সে সমাজের চরিত্র বোঝানোর জন্য প্রাক-রাজনৈতিক জনগণ (Pre- Political People) এবং প্রাক-রাজনৈতিক জন সমষ্টি (Pre-Political Populations) শব্দগুলো বার বার ব্যবহার করেছেন। অন্যদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার মতামতের যৌক্তিকতা যাই থাকুক না কেন, ঔপনিবেশিক বাংলার কৃষক বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝার জন্য তা খুব একটা সাহায্য করে না। কারণ এখানকার কৃষক- প্রজার বিদ্রোহগুলোতে যা ছিল তা সবই রাজনৈতিক। কেননা কৃষকরা যে অবস্থায় কাজ করতো, বসবাস করতো এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিসর সম্পর্কে তারা যে ধারণা রাখত তাতে এর বিপরীত কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। এ সকল কৃষক-প্রজার সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল গ্রামীণ ভূ-অভিজাতদের, যারা প্রতিনিয়ত কৃষককে শোষণ করে টিকে থাকত । এই শোষণ হতো বাজার অর্থনীতির (Market-Economy) অবাধ ব্যবস্থায় । এখানে আধিপত্যবাদী ও অধস্তনতার (কৃষক) সম্পর্ক ছিল অনেকটা সামন্তব্যবস্থার মতো রাজনৈতিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কের আড়ালে জবরদস্তির ব্যাপারটি এত নগ্ন এবং এতো সর্বগ্রাসী ছিল যে এ সম্পর্ক রাজনৈতিক ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কৃষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং এ সম্পর্ক ধ্বংসের জন্য কৃষকরা যে বিদ্রোহ করেছে তাও ছিল একান্তভাবে রাজনৈতিক ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অন্যমনস্ক হয়ে কৃষকদের পক্ষে বিদ্রোহ করার কোনো উপায় ছিল না। কারণ এ সম্পর্কে সরকারের কর্তৃত্ব এত সুদৃঢ় ছিল যে, এর উপর সামান্য হস্তক্ষেপও ছিল শাস্তিযোগ্য। সুতরাং বিদ্রোহের মাধ্যমে তা ধ্বংস করার চেষ্টা করতে যাওয়া ছিল কৃষকদের জন্য সব কিছুর ঝুকি নেওয়া। সুতরাং কৃষক বিদ্রোহের নেতাদের অবশ্যই এ ধরনের পরিকল্পনা করার আগে সব দিক বিচার বিবেচনা ও চিন্তাভাবনা করে অগ্রসর হতে হয়েছে। কৃষক যখন বিদ্রোহ করতো তখন সে জানত যে, সে কি করছে। ঊর্ধ্বতন শোষকগোষ্ঠীকে ধ্বংসের নির্মিতে ছিল প্রাথমিকভাবে এ বিদ্রোহ। তবে বিদ্রোহের পরিণামে পুরাতন নেতৃত্বের অবসানের ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণের জন্য থাকত না বিস্তৃত কোনো পরিকল্পনা বা নীল নকশা। কিন্তু তার মানে তা নয় যে, তা ছিল রাজনীতি বহির্ভূত। বরং নঞর্থক ও প্রত্যনুপাত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্রোহগুলো তার রাজনৈতিক চরিত্র চিহ্নিত করতো। শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতার কাঠামোর ঊর্ধ্বতন ও নিম্নশ্রেণির স্থান পরিবর্তন এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখে না যে এ ছিল ক্ষমতার লড়াই। বিদ্রোহের প্রায় ক্ষেত্রে, নেতৃত্ব, লক্ষ এবং পরিকল্পনার সামান্য খসড়া কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। তবে এ রাজনীতির পরিপক্কতাকে যদি বেশি মূল্য দেওয়া হয় এবং পরবর্তীকালের আরও জোরালো শ্রেণিসংগ্রাম, বিস্তৃত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল যদি আবার এর মধ্যে খোঁজ হয় তা হলে ভুল হবে।
নিম্নবর্গ গবেষক ড. রনজিৎ গুহ জোর দিয়ে বলেছেন যে, পল্লিবাসী প্রজার সশস্ত্র বিদ্রোহের যা কিছু ছিল তা সবই রাজনৈতিক। কেননা পরগনা নিরিখ সংরক্ষণে এবং পরে খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কৃষক শ্রেণি যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তা যে কোনো বিচারে ছিল রাজনৈতিক। তবে বাংলার কৃষক বিদ্রোহের রাজনৈতিক চেতনা- চরিত্র প্রমাণ করার অভিপ্রায়ে রনজিৎ গুহ, আধিপত্য, অধীনতা ও প্রতিরোধ (Domination-Subordination Resistance) শীর্ষক এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তার এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো শোষকশ্রেণির আধিপত্যের পাশাপাশি রয়েছে চাষিশ্রেণির (গুহের Subaltern) শোষণ সচেতনতা, যার ফলে তারা সব সময়ই চেষ্টা করেছে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে উল্টিয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের মতো করে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। তবে তার এ তত্ত্বের ব্যাপারেও তর্ক করা যেতে পারে। কেননা এই তত্ত্বের সারমর্ম হলো শ্রেণিচেতনা । কিন্তু কৃষকরা কতটুকু শ্রেণিচেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়েছিল এর কোনো সন্তোষজনক তথ্য নেই ৷
এছাড়া নরহরি কবিরাজ থেকে সুপ্রকাশ রায় পর্যন্ত মার্কসবাদী লেখকরাও বাংলার কৃষক সমাজকে অভিন্ন গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। অর্থাৎ শ্রেণিচেতনার আলোকে তাঁরা জমিদারবর্গকে একশ্রেণি এবং কৃষক গোষ্ঠীকে অন্য এক শ্রেণি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইতিহাসের বিচারে এই রকম কৃষক শ্রেণি বাস্তবে ছিল, তা প্রমাণ করে। বিদ্রোহী কৃষকদের মধ্যে শ্রেণিচেতনা জাগেনি। এর প্রমাণ হলো মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কৃষকরাও ধর্ম, বর্ণ ও সামাজিক বিধিনিষেধ দ্বারা অনুশাসিত হয়েছে । তারা তখনো উচ্চশ্রেণির নিকট যে কোনো ব্যাপারে ছিল বিচার প্রার্থী। তারা সময় সময় বিদ্রোহ করেছে প্রার্থিত বিচার না পেয়ে, শ্রেণিচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়। তাছাড়া শ্রেণিচেতনা সৃষ্টির জন্য যেরূপ নেতৃত্বের প্রয়োজন সেরূপ কোনো নেতৃত্বও কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। প্রায় প্রতিটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব ছিল অন্য শ্রেণি তথা বিত্তশালীদের হাতে। ফলে রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রি.), তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রি.) বা ফরায়েজি বিদ্রোহ (১৮৩৮-৪৬ খ্রি.) এর কোনোটিই মার্কসীয় মতে, শ্রেণি সংগ্ৰাম নয় ৷ এই ধরনের শ্রেণি সংগ্রাম ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তেভাগা আন্দোলন, ১৯৪৯ খ্রি. নাচোলের বিদ্রোহে আমরা প্রথম লক্ষ করি। সুতরাং কোনো যুক্তিতে নরহরি কবিরাজ ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের রংপুর বিদ্রোহকে শ্রেণি সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। ১৭৮৩ খ্রি. রংপুর বিদ্রোহ থেকে যদি শ্রেণি সংগ্রাম সত্যিই বাংলায়
চলত, তা হলে সারা বাংলায় প্রলেতারিয়েত (বঞ্চিত প্রজা সাধারণ) বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু ঘটনা এত সরলরেখায় ঘটেনি। সুতরাং রাজনীতি সচেতন কৃষকরা অন্য শ্রেণির সাহায্য সহযোগিতা ব্যতীত এককভাবে সরকার বা উচ্চশ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এমন কোনো তথ্য এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে ১৭৫৭-১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে আমাদের অভিমত এই যে, বিদ্রোহী কৃষকরা অবশ্যই অধিকার আদায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল কিন্তু শ্রেণিগতভাবে নয়। এতে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রমাণিত হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]