নবোপলীয় যুগের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিক বা পাথরের শেষ ধাপ নব্য প্রস্তর বা নবোপলীয় যুগ নামে পরিচিত। নবোপলীয় যুগকে মসৃণ পাথর ও ধাতু ব্যবহারের যুগ বলা হয়। যার কারণে নবোপলীয় যুগকে মানবসভ্যতার ভিত সংস্থাপনের পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ যুগেও মানুষের জীবনধারণের তথা বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন ছিল পাথর । নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ উন্নত হাতিয়ার তৈরি, কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন, পশুপালনের সূচনা, শস্য সংরক্ষণ পদ্ধতির মতো কতিপয় যুগান্তকারী দক্ষতা অর্জন করে ।
নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
উন্নত হাতিয়ার উদ্ভাবন : নব্য প্রস্তর যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উন্নত হাতিয়ার তৈরির উদ্ভাবন। এ যুগের হাতিয়ারগুলোতে ধারাবাহিক বিবর্তনের ছাপ সুস্পষ্ট। হাতিয়ারগুলো এসময়ে যথেষ্ট তীক্ষ্ণ, মসৃণ ও উন্নত হয়ে ওঠে। এ যুগে মাটি খুড়ে বীজ বপন বা আগাছা পরিষ্কারের জন্য নতুন ধরনের যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়। কুলো, হামানদিস্তা, শিলনোড়া, জাঁতা, হাতুড়ি, বাটালি, নেহাই প্রভৃতি যন্ত্রপাতির উদ্ভব এ যুগেই হয় । এছাড়া ফসল কাটার জন্য এসময়ে তৈরি করা হয় কাস্তে। এ যুগে প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতকুঠারের অভাবনীয় উন্নতি ঘটে। এসময় কুঠারের সামনের দিকটি অনেক বেশি তীক্ষ্ণ এবং কৃষিকাজ ও পশুশিকারের জন্য উন্নত হাতিয়ারের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি তা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় ।
২. উন্নত কৃষি ব্যবস্থার সূচনা : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ কৃষিক্ষেত্রে নানা কৌশল আবিষ্কার করে এবং স্থায়ীভাবে এক জায়গায় বসবাস শুরু করে। ফলে এ যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহকারী থেকে খাদ্য উৎপাদনকারী শ্রেণিতে পরিণত হয় । পূর্বে খাদ্য ও আশ্রয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় প্রকৃতিতে মানুষ ছিল বড়ই অসহায়। কিন্তু নব্য প্রস্তরযুগে কৃষির আবিষ্কারের ফলে মানুষের সেই অনিশ্চয়তা দূর হয় ।
৩. পশুপালন ব্যবস্থার উদ্ভাবন : নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ কৃষির প্রয়োজনে পশুপালন করতে শুরু করে । পশুকে কৃষিজমিতে কাজে লাগানোর মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। পরিবহণের ক্ষেত্রেও পোষ মানানো পশুকে কাজে লাগানো শুরু হয় । এসময় দক্ষিণ এশিয়ায় হাতি ও মহিষকে এবং জর্ডানে কুকুর ও ছাগলকে প্রতিপালন করা শুরু হয় । ৪. স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ : নব্য প্রস্তরযুগে কৃষির আবিষ্কারের ফলে মানুষ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার চিন্তা করে। ফলে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। এ যুগের শেষদিকে মানুষ কুটির বা গৃহনির্মাণ করতে শুরু করে। বাসস্থান তৈরির জন্য তারা গাছের ডালপালা, লতাপাতা, ঘাস প্রভৃতি ব্যবহার করতো। এ বসতি অঞ্চলে ক্রমে গ্রামে পরিণত হয় । কোথাও কোথাও এ গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৫. আগুনের বহুমুখী ব্যবহার : পুরোপলীয় যুগে আগুন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল অনেক কম। এসময়ে তারা আগুন জ্বালাতে পারত না এবং আগুনের ব্যবহারও জানত না। নব্য প্রস্তরযুগে পাথর দ্বারা পাথর ভাঙার সময় আগুন জ্বলে
ওঠার বিষয়টি মানুষ লক্ষ করে এবং তারপর পাথরের সাথে পাথর ঘষে বা কাঠের সাথে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালাবার কৌশল উদ্ভাবন করে। তাছাড়া মাটির পাত্রের সাহায্যে মাছ ও মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়া, শীত নিবারণ করা এবং বন্যপশুকে আগুন দিয়ে ভয় দেখানো প্রভৃতি কাজে আগুনের ব্যবহার ক্রমে বাড়তে থাকে ।
৬. সামাজিক বন্ধন : নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং বংশ রক্ষা করার জন্য বিবাহশাদি পদ্ধতির সূত্রপাত ঘটে। এসময়ে দুপ্রকার বিবাহের প্রচলন ছিল । যথা : একগামিতা ও বহুগামিতা। এ যুগে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী ছিল । একজনের একাধিক স্ত্রী থাকাতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি ব্যাপক রূপ ধারণ করলে সামাজিক বন্ধন অটুট হয় যা পরবর্তী সময়ে আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করে ।
৭. চিত্রশিল্প : নব্য প্রস্তরযুগে শিল্পীমনের সৌন্দর্যবোধকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য চিত্রশিল্পের বিকাশ ঘটে। এ যুগে মৃৎশিল্পীগণ মাটির তৈরি পাত্রে রঙের প্রলেপ দিয়ে সেগুলোকে বেশ আকষর্ণীয় করে তোলে । মৃৎশিল্পীগণ হাড়, কাঠি বা নখ দিয়ে নানা প্রকার রং জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করে পাত্রগুলোকে নানা রঙের বানাতেন। এভাবে নবোপলীয় যুগে শৈল্পিক সৌন্দর্যবোধের বিকাশের জন্য চিত্রশিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে ।
৮. ধর্মীয় অবস্থা : নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের ধর্মবিশ্বাস মূলত অনিষ্টকারী ও কল্যাণকারী উভয় শক্তিকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সূর্য, পাহাড়, ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনাকে মানুষ ভয় পেতে থাকে। ঝড়, ভূমিকম্প ও আগ্নেগিরির শক্তি দেখে মানুষ এগুলো তাদের দেবতারূপে ভাবতে থাকে। এভাবে কৃষি কাজের জন্য পানি ও সূর্য অত্যন্ত প্রয়োজন বিধায় তারা বৃষ্টি ও সূর্যকে দেবতা ভেবে আরাধনাও শুরু করে ।
৯. শ্রমের বিভাজন : নব্য প্রস্তরযুগে সব গৃহস্থ পরিবারই নিজেদের সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র নিজেরাই ব্যবস্থা করতো। এ সময়ে মেয়েরা শিশুদের প্রতিপালন, খাদ্য প্রস্তুত, পশুপালন, বুনন প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য ও ঘরোয়া কাজগুলো সম্পাদন করতো। অন্যদিকে, পাথর কেটে বা ভেঙে তা দিয়ে ধারালো অস্ত্র তৈরি, পশুশিকার জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা, গুহা নির্মাণ, বীজবপনের জন্য জমিচাষ করার মতো কষ্টসাধ্য কাজগুলো পুরুষরা অতি দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতো ।
১০. অন্যান্য বৈশিষ্ট্য : কৃষি আবিষ্কারের ফলে নব্য প্রস্তরযুগে মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান করতে সক্ষম হলে তাদের খাদ্যের জন্য চিন্তা না থাকায় অবসরকালে মানুষ তাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নৌকায় পাল খাটানো, গৃহনির্মাণ, সমাধি সাজানোর দক্ষতা বা গুণ অর্জন করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নব্য প্রস্তর যুগের স্থায়িত্বকাল পুরাতন প্রস্তর যুগের তুলনায় অনেক কম হলেও নব্য প্রস্তর যুগের অগ্রগতি ও প্রাপ্তি ছিল অনেক বেশি। মূলত এসময়েই মানুষ উন্নত সভ্যতা ও সমৃদ্ধির পথে পা বাড়ায় । নবোপলীয় যুগকে মানুষের বন্যদশা বলা হলেও প্রকৃত বিচারে মানব সভ্যতার মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় যা নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোই নব্য প্রস্তর যুগকে ক্রমশ প্রোটো ঐতিহাসিক যুগে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]