নব্য প্রস্তর যুগের আবিষ্কারগুলোর বর্ণনা দাও ।

উত্তর ভূমিকা : নব্য প্রস্তর যুগ মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুৰুত্বপূৰ্ণ যুগ হিসেবে বিবেচিত। এ যুগের মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তারে অন্যান্য যুগের তুলনায় অধিক পারদর্শী ছিল। নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের প্রধান উদ্ভাবন হলো খাদ্য উৎপাদন করা। এ যুগ ছিল আধুনিক মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এ যুগে মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় । উন্নত হাতিয়ার তৈরি থেকে শুরু করে কৃষির উদ্ভাবন, জীবজন্তুকে গৃহপালিতকরণ, মৃৎপাত্র তৈরি ইত্যাদি নব্য প্রস্তর যুগের যুগান্তকারী উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই এ যুগকে নবোপলীয় বিপ্লব নামেও আখ্যা দেওয়া হয় ।
• নবোপলীয় বিপ্লব : প্রাগৈতিহাসিক যুগের শেষ ধাপ নব্য প্রস্তর বা নবোপলীয় যুগ নামে পরিচিত। নবোপলীয় যুগকে মসৃণ পাথর ও ধাতু ব্যবহারের যুগ বলা হয়। নবোপলীয় বা নব্য প্রস্তর যুগের প্রারম্ভিককাল নির্ণয় করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য । প্রচলিত ধারণা অনুসারে, পুরানো প্রস্তর যুগের সমাপ্তির পর মধ্য প্রস্তর যুগ দশ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় এবং ছয়/সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ যুগের অবসানের পর নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। নবোপলীয় যুগে মানুষ পাথরকে নতুনভাবে করায়ত্ত করে এর দ্বারা অপেক্ষাকৃত উন্নত, মসৃণ ও ধারালো অস্ত্র তৈরি করে এবং কৃষিকাজসহ নানাভাবে পাথরকে সার্থকরূপে ব্যবহার করে সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনে। যাকে প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ভি. গর্ডন চাইল্ড নবোপলীয় বিপ্লব (Neolithic Revolution) বলে অভিহিত করেন।
নবোপলীয় যুগে মানুষের কৃতিত্বসমূহ : নবোপলীয় যুগে বা নব্য প্রস্তরযুগে মানুষের কৃতিত্বসমূহ আলোচনা করা হলো : ১. উন্নত হাতিয়ার তৈরি : নবোপলীয় যুগে মানুষ পূর্ববর্তী সময়ের হাতিয়ারগুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া তারা উন্নয়নের পাশাপাশি অনেক নতুন হাতিয়ারেরও উদ্ভাবন করে। এসময় তারা পাথর, কাঠ, বাঁশ, হাড় প্রভৃতি দ্বারা হাতিয়ার তৈরি করতো। এ যুগের মানুষের হাতিয়ারগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও তীক্ষ্ণ। এসময় কুঠার, চাকু, কোদাল, গাঁইতি, বর্শা ও তিরসহ বিভিন্ন রকম হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হতো ।
২. কৃষি আবিষ্কার : নবোপলীয় যুগের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের মধ্যে কৃষি অন্যতম। মানব সভ্যতার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় কৃষি আবিষ্কারকে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলে চিহ্নিত করা হয়। কৃষি উদ্ভাবনের ফলে খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষ খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত হয়। এর মাধ্যমে মানুষ যাযাবর বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কৃষি উৎপাদনের ফলে মানুষের অভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটে। এ যুগে তারা বিভিন্ন রকম ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। নব্য প্রস্তরযুগে সবজি এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য; যেমন— ভুট্টা, অতসী, তামাক, শিম, কুমড়া, গোলআলু ইত্যাদি উৎপাদিত হতো । এছাড়া এসময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুর, আঙুর, ডুমুর, জলপাই প্রভৃতি চাষ করা হতো ।
৩. পশুপালন : নবোপলীয় যুগে শিকারি মানুষ উন্নত হাতিয়ার ব্যবহারের ফলে পর্যাপ্ত শিকার গেত। অনেক সময় উদ্বৃত্ত পশু হত্যা না করে পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেওয়া হতো। এভাবে দিনে দিনে পশুগুলো গৃহপালিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা আবিষ্কার করে যে; এগুলোকে হত্যা না করে প্রতিপালন করা অধিকতর লাভজনক। অন্যদিকে, তৃণভোজী পশুগুলো মানুষের কৃষিক্ষেত্রের আকর্ষণে লোকালয়ের কাছে চলে আসত। এসব পশু নিরীহ ও দুর্বল ছিল বলে সেগুলোকে অতি সহজেই বশে আনা যেত। নব্য প্রস্তর যুগের গৃহপালিত পশুর মধ্যে কুকুর, গরু, মহিষ, ছাগল, শূকর, ভেড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
৪. কাপড় বুনন : নবোপলীয় যুগে মানুষের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো বয়নতন্তুর আবিষ্কার। তারা উদ্ভিদজাত ও পশুজাত তন্তু থেকে সুতা তৈরি করে সেই সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি করতে পারত। তৎকালে শণ, অতসী, তুলা থেকে উদ্ভিদজাত এবং ভেড়া ও ছাগলের পশম থেকে পশুজাত তন্তু তৈরি করে বিভিন্ন রকমের কাপড় প্রস্তুত করা হতো। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দে সিদ্ধান্তে সুতা উৎপাদনের জন্য তুলার চাষ হতো। সে সময়ে তাঁতে কাপড় বোনার ক্ষেত্রে মেয়েরা পারদর্শিতা অর্জন করতে শেখে। তাদের তৈরি ও পরিধানকৃত পোশাক-পরিচ্ছদে বিভিন্ন ধরনের কারুকার্যেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডের একটি স্থানে হ্রদের পানি অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে গেলে হ্রদের তলদেশে আদিম (নব্য প্রস্তর) যুগের মানুষের পোশাক পাওয়া যায় ।
৫. চিকিৎসা সেবা : নবোপলীয় যুগের মানুষ বিশ্বাস করতো যে, অপদেবতাদের প্রভাবে মানুষের বিভিন্ন প্রকার অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা রোগ প্রতিকারের জন্য জাদুবিদ্যাই বেশি প্রয়োগ করতো। তবে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ ক্ষত চিকিৎসার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ বিভিন্ন গাছগাছড়া, লতাপাতা, ফলমূল ও বিভিন্ন ধরনের গুল্মের ব্যবহারও করতো। নব্য প্রস্তর যুগের শেষদিকে কিছু শল্যচিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় ।
৬. বিনিময় : নবোপলীয় যুগে বিনিময় প্রথার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এ যুগে মানুষ স্বীয় উৎপাদিত পণ্য অন্যকে দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস অন্যের কাছ থেকে গ্রহণ করতো। এভাবেই পণ্যের মাধ্যমে বিনিময় প্রথার উদ্ভাবন হয় । এ যুগে ফসল, পশু, মাংস, দুধ, চামড়া, তাঁতের কাপড়, মাছ, কাঠ, জ্বালানি কাঠ, ফল প্রভৃতি পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্ত অংশ অন্যজনকে দিয়ে নিজ প্রয়োজনের পণ্যটি বিনিময় করতো। এভাবেই ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রপাত হয় ।
৭. শিল্পকলা : নবোপলীয় যুগে শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান হলো মৃৎপাত্র। এসময় মৃত্তিকা দ্বারা নানা আকৃতির এবং নানাবিধ নকশার মৃৎপাত্র তৈরি হতে থাকে। এসব মৃৎপাত্র গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া নব্য প্রস্তর যুগের শিল্পীরা মাটি দিয়ে নানারকমের পুতুল ও মূর্তি তৈরি করতো। জেরিকো (প্যালেস্টাইন), জারমো (ইরাক) থেকে এ ধরনের মাটির শিল্পকর্ম আবিষ্কার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মূর্তি রয়েছে। এগুলোকে মাতৃকা মূর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৮. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : রাষ্ট্র সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। সমাজের শান্তি রক্ষা করা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ। নব্য প্রস্তরযুগে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি গঠন করে সমাজে সর্বজনীন কল্যাণের চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রের আইন, বিধিব্যবস্থা, পুলিশ, সৈন্য, বিদেশিদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৯. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা অপরিহার্য। নব্য প্রস্তরযুগে কৃষি ও পশুপালন শুরু হওয়ায় মানুষের খাদ্য সমস্যা বহুলাংশে হ্রাস পায়। বিনিময় প্রথা প্রচলিত হওয়ায় তৎকালীন স্থল ও জলপথে চাহিদাবিশিষ্ট অঞ্চলে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করা সম্ভব হয়। এর ফলে তৎকালীন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয় ৷
১০. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ প্রকৃতি পূজা থেকে ক্রমেই সরে এসে ঈশ্বর তত্ত্বের দিকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। তবুও অপদেবতা, মৃতের আত্মা, ঝড়, বজ্রপাত প্রভৃতি অকল্যাণ তাদের মন থেকে মুছে যায়নি।
১১. বিনোদন ব্যবস্থা : নবোপলীয় যুগের মানুষ বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নাচগান, খেলাধুলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ তারা করে আনন্দ লাভ করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে নবোপলীয় যুগ একটি অবিস্মরণীয় যুগ । নব্য প্রস্তর যুগের আবিষ্কার পৃথিবীতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার উন্মেষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। আবহাওয়ার উষ্ণতা, মানুষের ওপর বন্যপশুর নির্ভরশীলতা তথা পশুপালন, কৃষিকাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণ প্রভৃতি নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের পারিবারিক ও গোষ্ঠী জীবনে একটি আমূল পরিবর্তন সাধন করে। তাই নব্য প্রস্তর যুগ মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]