ঐতিহাসিক যুগ কাকে বলে? ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : আদিম গুহাবাসী মানুষ ধীরে ধীরে বিভিন্ন আবিষ্কার ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে জীবন প্রণালিকে উন্নততর করে তোলে। ফলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগে মানুষ প্রবেশ করে। ঐতিহাসিক যুগের সময়কাল মূলত মানব সভ্যতার উন্নতিকাল। এসময় মানুষ লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে, কৃষির উন্নয়ন ঘটায়, সামাজিক জীবনে মূল্যবোধের সমাবেশ ঘটায় প্রভৃতি। ফলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিধারাও স্বাচ্ছন্দ্য হতে শুরু করে। যার চূড়ান্ত রূপ আজকের আধুনিক সভ্যতা।
ঐতিহাসিক যুগ : সাধারণত প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের পর যে যুগ শুরু হয় তাকে ঐতিহাসিক যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক যুগকে যথাযথভাবে মানব সভ্যতার যুগ বলা হয়। ঐতিহাসিক যুগে বন্যতা থেকে বর্বরতা এবং বর্বরতা থেকে প্রকৃত সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন ও লিখিত বিবরণের অস্তিত্বকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে একথা স্বীকার্য যে, পৃথিবীর সব অঞ্চলে একই সাথে লিখন পদ্ধতির সূচনা হয়নি বলে সব অঞ্চলে একই সাথে ঐতিহাসিক যুগের সূচনাও ঘটেনি। যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মানুষ যখন লিখন পদ্ধতির সূচনা করে, তখন থেকে ইতিহাসের উৎস হিসেবে অলিখিত উপাদানের পাশাপাশি লিখিত উপাদানও পাওয়া যেতে থাকে। গ্রামীণ সভ্যতার পরিবর্তে মানুষ নগর গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুনভাবে জীবনযাত্রা শুরু করে আর তখন থেকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক যুগেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সভ্যতা বিকশিত হয়।
ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ : নিম্নে ঐতিহাসিক যুগের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাচীন যুগ : প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের অবসানের পরই যে যুগের সূচনা হয় তাকে প্রাচীন যুগ বলে অভিহিত করা হয়। আবার অন্যভাবে বলা যায়, ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভকাল থেকে যে যুগের সূচনা ঘটে তাকে প্রাচীন যুগ বলা হয় । ক. প্রাচীন যুগের ব্যাপ্তিকাল : ঐতিহাসিক যুগের সূচনাকাল ও প্রাচীন যুগের সূচনাকাল একই। প্রাচীন যুগের শুরু আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর পূর্বে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাচীন যুগের শুরু ও সমাপ্তির ভিন্ন ভিন্ন সময়কাল রয়েছে। যেমন— ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণ সেনের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমান শাসকদের সূত্রপাত ও প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল প্রাচীন যুগের অন্তর্ভুক্ত।
খ. প্রাচীন যুগের উল্লেখযোগ্য দিক : প্রাচীন যুগে মানুষ পূর্ববর্তী প্রাগৈতিহাসিক ও প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের গ্রামীণ সভ্যতার গণ্ডি পেরিয়ে নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। রোম, এথেন্স, স্পার্টা প্রভৃতি নগর গড়ে তুলে মানুষ প্রাচীন যুগে সভ্যতাকে ব্যাপকভাবে অগ্রগামী করতে সক্ষম হয়। ধীরে ধীরে মানুষ নগর রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলে । প্রাচীন যুগে নগর ও নগররাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মানুষ আইন ও বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে মানুষ আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করার জন্য শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। এভাবে অর্থ উপার্জনে নিশ্চয়তা আসলে প্রাচীন যুগে কর ব্যবস্থা ও মুদ্রা অর্থনীতি চালু হয় ।
২. মধ্যযুগ : সাধারণভাবে ঐতিহাসিক যুগের মধ্যম পর্বকে মধ্যযুগ বলে অভিহিত করা হয়। প্রাচীন যুগ অপেক্ষা কতিপয় ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মধ্যযুগকে প্রাচীন ও আধুনিক যুগ হতে পৃথক করা হয়েছে। প্রাচীন যুগের শেষ পর্যায়ে এমনকিছু অভিনব বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে থাকে যার কারণেই মূলত ঐতিহাসিকরা প্রাচীনযুগের অবসান প্রত্যক্ষ করেন ।
ক. মধ্যযুগের ব্যাপ্তিকাল : অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে, ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম বর্বরত জার্মান জাতি কর্তৃক পতন হওয়ার পর থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে ওসমানি তুর্কিদের হাতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পতন পর্যন্ত সময়কালকে মধ্যযুগ বলে ধরা হয়। তবে পৃথিবীর সব প্রান্তে একই সময়ে মধ্যযুগের সূচনা হয়নি। বাংলায় এর ব্যাপ্তিকাল হলো ১২০৪–১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ।
খ. মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য দিক : পোপতন্ত্র মধ্যযুগের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। এ সময়ে পোপগণ রাজার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠলে রাজা, পোপ, সামন্ত শ্রেণির মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধের শেষ পর্যায়ে পোপতন্ত্র, রাজতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্রের বিন্যাসের মাধ্যমে জনগণের শক্তি বৃহৎ আকার ধারণ করে । মধ্যযুগের অন্য একটি প্রভাবশালী ঘটনা হলো ক্রুসেড । ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে একাদশ ও দ্বাদশ শতকব্যাপী প্রায় ৮টি ক্রুসেড পরিচালিত হয় ।
মধ্যযুগে আরেকটি অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা রেনেসাঁর আবির্ভাব। এছাড়াও মধ্যযুগে সামন্তবাদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব, শহরের উদ্ভব ও বিকাশ, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও অন্ধবিশ্বাস, অন্ধকার যুগের উদ্ভব, মঠতন্ত্র প্রভৃতিও বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
৩. আধুনিক যুগ : সাধারণভাবে ঐতিহাসিক যুগের সর্বশেষ পর্যায়কে আধুনিক যুগ বলে অভিহিত করা হয়। মধ্যযুগ ও উত্তর আধুনিক যুগের মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত আধুনিক যুগ মানব সভ্যতাকে পরিপূর্ণতা দান করে। মধ্যযুগের শেষদিকে ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যে এমন কিছু নতুনত্ব ও মৌলিক পরিবর্তন দেখা যায় যার ফলে মধ্যযুগ হতে পরবর্তী ইতিহাসকে আধুনিক যুগ হিসেবে নামকরণ করা হয় ।
ক. আধুনিক যুগের ব্যাপ্তিকাল : অধিকাংশ পণ্ডিত ইউরোপের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আধুনিক যুগের সূচনাকারী হিসেবে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দকে সমর্থন করেন এবং ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির সাথে সাথে আধুনিক যুগের সমাপ্তি ঘটে বলে একমত পোষণ করেন।
খ. আধুনিক যুগের উল্লেখযোগ্য দিক : আধুনিক যুগে মানুষ সভ্যতা, প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে জ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা জয় করতে সক্ষম হয়েছে। এ যুগের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ, জাতীয় রাষ্ট্র গঠন, ভৌগোলিক আবিষ্কার, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসন, গণতন্ত্র, পৃথিবীর মহাদেশীয়করণ, জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লব, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৈত্রীজোট গঠন, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির পরিবর্তে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি, আধুনিক সমরতন্ত্র (ট্যাংক, যুদ্ধ বিমান, সাবমেরিন, পারমাণবিক বোমা ইত্যাদি) উন্নত যোগাযোগ ও মাধ্যম (স্টিমার, ট্রেন, উড়োজাহাজ, রেডিও, টেলিভিশন, টেলিগ্রাম, টেলিফোন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি) রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা প্রভৃতি। এসব বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগকে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য করে দেয় । যা মানুষের আর্থসামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনে ।
উত্তর আধুনিক যুগ : অনেক ঐতিহাসিক আধুনিক যুগকে দু ভাগে বিভক্ত করার পক্ষে যুক্তি পেশ করেন। তাদের মতে, আধুনিক যুগের সমাপ্তিতে যে যুগের সূচনা হয় তা উত্তর আধুনিক যুগ বা অত্যাধুনিক যুগ হিসেবে পরিচিত ।
এসময়কার কয়েকটি প্রভাবশালী ঘটনা হলো স্নায়ুযুদ্ধ, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা, মহাকাশ ভ্রমণ, মহাশূন্যে স্টেশন স্থাপন, কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ প্রভৃতি বিষয় আধুনিক যুগ ও উত্তর আধুনিক যুগের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এছাড়াও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক কার্যক্রম, বহুমুখী পররাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, বিশ্বায়ন প্রভৃতি উত্তর আধুনিক যুগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক যুগে (প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ও উত্তর আধুনিক) মানুষ জ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটায়। ধীরে ধীরে মানুষ জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয়। এ জ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন মানুষকে অনেক অসাধ্য কর্ম সাধনে সহায়তা করেছে তেমনি মানুষ সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে যেহেতু মানুষই পৃথিবীর সবচেয়ে বিবেকবোধসম্পন্ন প্রাণী তাই মানুষকেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ঐতিহাসিক যুগের সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি গ্রহণ করতে হবে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]