মধ্যযুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা : মানবজাতির ইতিহাস অবিশ্রান্ত ধারায় প্রবহমান। ইতিহাসের গতিময়তার কোনো কাল বা স্তর তার এ গতিকে রুদ্ধ করতে পারে না। কোনো কালে প্রবেশের সময় হয়তো কোনো শক্তি দ্বারা এটি প্রভাবিত হচ্ছে। মধ্যযুগ নিরূপণ করতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ১৪৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান বা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অটোমান তুর্কিদের হস্তগত হওয়ার পূর্বের সময়কে মধ্যযুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।
● মধ্যযুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ : নিম্নে মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. কঠোর সামাজিক অনুশাসন : মধ্যযুগে ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সমাজের প্রতি স্তরেই ব্যক্তি কতকগুলো লৌহকঠিন নিয়মশৃঙ্খলা, আচার আচরণ, রীতিনীতি দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। কৃষকরা সামন্তবাদীদের দ্বারা কঠিন আদেশে আবদ্ধ ছিল। শিল্পকারও শিল্পীসংঘের কঠিন নিয়মে আবদ্ধ ছিল। ধর্মাধিষ্ঠানের দ্বারা ব্যক্তির ধর্ম, ব্যক্তিগত জীবন এমনকি তার চিন্তাধারা সম্পূর্ণভাবে কঠোর নিয়মনীতিতে আবদ্ধ ছিল ।
২. ব্যক্তির শৃঙ্খল মুক্তির চেষ্টা : মধ্যযুগের শোষিত অবস্থায় ব্যক্তি যখন বন্দি এবং কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ ঠিক তখনই ব্যক্তিত্বের প্রকাশ সম্ভব ছিল। ব্যক্তি যেহেতু কোনো পদার্থ নয়, তাই শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তার মানসিক বৃত্তিগুলোর অনুপলুব্ধ বিবর্তন চলছিল। মধ্যযুগের শেষভাগে ব্যক্তির শৃঙ্খল মুক্তির চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
৩. প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রভাব : আরবগণ কর্তৃক স্পেন অধিকৃত হওয়ার সাথে সাথে তৎকালীন ইউরোপীয় সংস্কৃতি অপেক্ষা উন্নত আরবীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপীয়দের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এটি ছাড়া ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরোপ প্রাচ্যের সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল ।
৪. ধর্মীয় কর্তৃত্ব : মধ্যযুগে সর্বত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এ যুগে রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, জ্ঞানচর্চা, ব্যক্তিজীবনসহ প্রায় সব বিষয়কে ধর্ম তথা খ্রিস্টধর্ম অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে । পোপ ও যাজকগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ধর্মীয় নীতির দ্বারা সর্বত্র এক বেড়াজালের সৃষ্টি করেন। এসময় ধর্মজ্ঞানের বাইরে কোনোকিছু জানা কিংবা বুঝা এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিল ।
৫. ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয় : মধ্যযুগে একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয় ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে। অল্প সময়ের মধ্যে ইসলাম ধর্ম এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়। ফলে মধ্যযুগের ধর্মীয় ধারণার ন্যায় ও সমতার ধর্ম ইসলাম কোটি কোটি মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় ।
৬. ধর্মীয় বিচারালয় স্থাপন : মধ্যযুগে গির্জার প্রধানগণ রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রবেশ করে। ফলে এসময় ধর্মীয় যাজকরা নিজস্ব আইনকানুন প্রবর্তন ও বিচারালয় স্থাপন করেন। এ যুগে গির্জা তার নিয়মভঙ্গের অপরাধে গোটা দেশকে একঘরে রাখার ক্ষমতা অর্জন করে। এছাড়া যাজকরা প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধীদের শাস্তিদানে হোলি ইনকুইজিশন নামক একটি আদালত গঠন করেন ।
৭. পোপতন্ত্রের প্রাধান্য : মধ্যযুগে শাসনব্যবস্থায় পোপের প্রাধান্য ছিল সর্বত্র। ধর্মীয় ক্ষেত্রে পোপের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। এসময় পোপগণ চার্চকেন্দ্রিক প্রশাসন গড়ে তুলে সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান, মুদ্রা জারি, আদালত পরিচালনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল প্রভৃতির দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন ।
৮. পোপ ও সম্রাটের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। এ পর্যায়ে রোমান সম্রাট এবং পোপের মধ্যে তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পোপ রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য দাবি করলেও সম্রাটও ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রোমান সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দাবি করেন। আর এ দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ সম্রাট এবং পোপ উভয়েরই শক্তি হ্রাস পেতে থাকে ।
৯. শক্তিশালী রাজতন্ত্র : অতঃপর সামন্ততন্ত্র বা প্রথা দুর্বল হতে শুরু করে, পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ প্রভৃতি রাজার হস্তগত হলে রাজশক্তি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে । স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রাজশক্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
১০. মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ : রাজশক্তির বৃদ্ধির ফলস্বরূপ ক্রমান্বয়ে সামন্ত অভিজাত শ্রেণির প্রাধান্য হ্রাস পেতে শুরু করে এবং দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। আর এ মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজশক্তির নির্ভরযোগ্য সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজশক্তির হাত আরও শক্তিশালী করার ফলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের ন্যায় দেশের বাইরেও রাজশক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বাড়তে থাকে ।
১১. জাতীয় চেতনার উদ্ভব : মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলোতে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনার ধারা ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে । আর এ জাতীয় চেতনার উন্মেষ জাতি রাষ্ট্রের গঠনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে ।
১২. জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপট : পোপের ক্ষমতা ও প্রাধান্য হ্রাস, পাশাপাশি সম্রাটের আধিপত্য হতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা প্রভৃতি তৎকালীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এসবের প্রেক্ষিতেই জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মধ্যযুগের বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চা ও উন্নত সভ্যতার পরিবর্তিত রূপই আধুনিক ইউরোপের জন্ম দিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্নতা, পোপতন্ত্র, ক্রুসেড জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তাহীনতা পরিস্থিতি ও প্রগতি বিরোধী কার্যকলাপ মধ্যযুগকে পশ্চাৎপদ করে। তবে এ পশ্চাৎপদতার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে দ্বাদশ শতকের রেনেসাঁ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এভাবে মধ্যযুগের ক্রমোন্নতির ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগ আধুনিক যুগের সংগঠনের পথে এগিয়ে চলে । এ কারণে মধ্যযুগকে স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]