উত্তর ভূমিকা : মানবসভ্যতার ইতিহাসে আধুনিক যুগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। বাংলায় আধুনিকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Modern এর উৎপত্তি Mode থেকে। এর অর্থ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি। অর্থাৎ যে প্রক্রিয়া পূর্বতন পদ্ধতি বা প্ৰক্ৰিয়া থেকে ভিন্ন, গতানুগতিক থেকে স্বতন্ত্র তাই আধুনিক নামে পরিচিত। এটি মানবীয় চিন্তাধারার বিকাশের একটি মৌলিক স্তর বা পর্ব। পনেরো শতকে রেনেসাঁর (১৪৫৩ খ্রি.) মধ্য দিয়ে এ যুগের শুভসূচনা হয়েছিল। এ যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে এতটাই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা পূর্বেকার, সব যুগ ও সমাজব্যবস্থার সম্মিলিত অর্জনের চেয়েও অনেক বেশি আকর্ষণীয়, রোমাঞ্কর ও তাৎপর্যপূর্ণ।
আধুনিক যুগের উদ্ভব ও বিকাশ : নিম্নে আধুনিক যুগের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ক. আধুনকি যুগের উদ্ভব : হঠাৎ করেই আধুনিক যুগের উদ্ভব ঘটেনি । এর পিছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ নিহিত ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রেনেসাঁ বা নবজাগরণ : ইউরোপের ইতিহাসে আধুনিক যুগ চিহ্নিত হয়ে থাকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ হিসেবে। বস্তুত মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের মাঝে চিহ্নিত সীমারেখা হচ্ছে এ নবজাগরণ। ইউরোপের ইতিহাসে প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁ বলতে বুঝায় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, বিজ্ঞান তথা জ্ঞানবিজ্ঞানকে জানার জন্যে গভীর আগ্রহ এবং উৎসাহ সৃষ্টি হওয়া। মোটকথা পুরনো ও স্থবির সামন্ত আর্থসামাজিক কাঠামো ভেঙে নতুন সমাজ সৃষ্টি বা পরিবর্তন প্রক্রিয়ার অপর নাম হলো রেনেসাঁ ।
২. ধর্মসংস্কার ও প্রতিসংস্কার আন্দোলন : আধুনিক যুগের সূত্রপাতের ক্ষেত্রে ধর্মসংস্কার ও প্রতিসংস্কার আন্দোলনও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে সামন্তবাদ এবং ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ যে আন্দোলন শুরু হয় ইতিহাসে তা ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত। যার উদ্যোক্তা ছিলেন মার্টিন লুথার। জার্মানিতে এ আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুতই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ ক্যাথলিকগণ যে অভিযান পরিচালনা করে তা প্রতিসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত। এসব আন্দোলন সমাজের চাহিদাকে ধারণ করে ইউরোপে উদারনৈতিক শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করে, যা আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটায় ।
৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বিকাশ : আধুনিক যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকাশ। মধ্যযুগের ইউরোপের সামন্তবাদী আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে ব্যক্তির স্বাধীনতা বা ব্যক্তির সামাজিক উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তার সামাজিক উপস্থিতি স্বীকৃত হয় ।
৪. সামন্তবাদের অবসান : আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ছিল সামন্তবাদের অবসান। মধ্য ও আধুনিক যুগের
ক্রান্তিলগ্নে সামন্তবাদের অবক্ষয় শুরু হওয়ার ফলে ধীরে ধীরে ভূমিদাসরা স্বাধীন কৃষক শ্রেণিতে পরিণত হয় ।
৫. মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব : আধুনিক যুগের উত্তরণে আর একটি বড় পরিবর্তন হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। যাজক, অভিজাত ও তৃতীয় শ্রেণির পূর্বতন সমাজব্যবস্থার প্রধান তিনটি শ্রেণির অবস্থান থাকলেও আধুনিক যুগে নিম্ন শ্রেণির অভিজাত বা মোটামুটি সচ্ছল বিশেষ শ্রেণির উদ্ভব ঘটে যা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে পরিচিত ।
৬. অর্থনীতির নতুন মেরুকরণ : আধুনিক যুগে গিল্ডের অবক্ষয়, পুঁজিবাদের বিকাশ ও কৃষি প্রধান অর্থনীতির স্থলে শিল্প প্রধান আর্থনীতির বিকাশ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে ।
৭. ভৌগোলিক আবিষ্কার : ভৌগোলিক আবিষ্কার আধুনিক যুগের গতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। নিজস্ব শিল্পজাত দ্রব্যাদির জন্য উপযুক্ত বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ভৌগোলিক আবিষ্কারের উম্মাদনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে ভৌগোলিক আবিষ্কার উপনিবেশ স্থাপনে সহায়তা করে থাকে ।
৮. বাণিজ্যের বিস্তার : ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে ক্রমশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে । উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা কম থাকায় উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রয়ের লক্ষ্যে বহির্বাণিজ্যের প্রয়োজন দেখা দেয় + আর এ বাণিজ্য বিস্তারের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আটলান্টিকের দিকে ধাবিত হয়। ফলে বহির্বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি পায় যা আধুনিক যুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
খ. আধুনিক যুগের বিকাশ : ইতিহাসে আধুনিক যুগ তিনটি পর্বে বিকাশ লাভ করে । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো : প্রথম পর্ব : আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব শুরু হয় পনেরো শতকের রেনেসাঁর সময় থেকে এবং তা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ পর্বে সামন্তবাদী অর্থনীতির অবসান ঘটে এবং পুঁজিবাদের ভিত্তি রচিত হয়। দ্বিতীয় পর্ব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লব থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৮) পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্বে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত সংহত হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিস্তার ঘটে এবং চিন্তাজগতে হাজারো পরিবর্তন সাধিত হয়। বিকাশ লাভ করে সমাজতন্ত্রবাদ ।
তৃতীয় পর্ব : আধুনিক যুগের তৃতীয় পর্ব পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় । এ পর্বে ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুগের মতো ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়। এ পর্বে বিশ্বশান্তির স্বপ্ন নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত হয় । তবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং যুদ্ধের হুমকি হ্রাস পায়নি। এ পর্বে অভাবনীয় রূপে প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশসহ আধুনিক যুগের এ পর্বে পুরো বিশ্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক যুগের উদ্ভব ও বিকাশ মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং ঘটনাবহুল একটি অধ্যায়। এসময়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। বিস্তার ঘটেছিল বাণিজ্যেরও। নব নব বৈজ্ঞানিক ও ভৌগোলিক আবিষ্কার সংঘটিত হয়। আর এসবের সমন্বয়ে আধুনিক যুগের সূচনা এবং মধ্যযুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। বস্তুত চৌদ্দ থেকে ষোলো শতক পর্যন্ত ইউরোপের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি রেনেসাঁসের প্রভাবে বিকশিত হয়ে আধুনিক যুগের সূচনা হয় ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত