উত্তর ভূমিকা : বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী প্রাণীসমূহের মধ্যে মানুষ অগ্রগণ্য। আদিমকালে জীবজন্তুর আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা বিপদে মানুষ ছিল অসহায়। অস্তিত্ব রক্ষা আর জীবনযাপনের চাহিদা পূরণের জন্য তারা একে অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে। এভাবে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করতে গিয়ে মানুষ গড়ে তুলেছে সমাজ। মানবসমাজ আদিমকাল থেকে বর্তমান উত্তর আধুনিককাল পর্যন্ত এক নীরব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আর এসব বিবর্তন বিভিন্ন ধাপে ধাপে সংঘটিত হয়েছে।
• মানবসমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় : কালের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে মানবসমাজের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়কে মোটামুটি বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে— ১. শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ ভিত্তিক সমাজ, ২. উদ্যানভিত্তিক সমাজ, ৩. পশুপালন সমাজ, ৪. কৃষিভিত্তিক সমাজ, ৫. শিল্পভিত্তিক সমাজ, ৬. শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সমাজ এবং ৭. উত্তর আধুনিক সমাজ। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. শিকার ও খাদ্যসংগ্রহভিত্তিক সমাজ : শিকার ও খাদ্যসংগ্রহভিত্তিক সমাজ হচ্ছে মানবসমাজের আদিমতম রূপ। তখন স্থায়ী কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। এসময় মানুষ গুহা ও বনজঙ্গলে বাস করতো। প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল প্রচুর। কিন্তু এ সম্পদকে সঠিক ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করতে শেখেনি। বনজঙ্গল থেকে তারা খাবার সংগ্রহ এবং শিকার করতো । খাবারের খোঁজে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াত। ফলমূল সংগ্রহ, পশুপাখি ও মৎস্য শিকার ছিল আদিম সমাজের মানুষের প্রধান কাজ। যখন শিকার মিলত তখন তারা খেত, শিকার না মিললে উপোস থাকতে হতো। মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ করতো আর পুরুষেরা শিকার করতো। এ সমাজের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ারগুলো হচ্ছে খাঁজকাটা বল্লম, মাছ ধরার হারপুন হারের সুই ইত্যাদি। শীত ও রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ গাছের ছাল ও লতাপাতা এবং পশুর চামড়া ব্যবহার করতো ।
২. উদ্যান কৃষিভিত্তিক সমাজ : এ সমাজে খাদ্যসংগ্রহকারী মানুষ খাদ্য উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মেয়েরাই কৃষি কাজের উদ্ভাবন করেছে। আদিম সমাজে পুরুষেরা যেত শিকারের সন্ধানে, ফলমূল আহরণের ভার ছিল মেয়েদের ওপর। ফলমূল সংগ্রহ করতে গিয়ে কখনও তারা নিয়ে আসত বুনো গম ও বার্লি, মেটে আলু, কচুর মূল ও কন্দ। আস্তানার আশেপাশে গম ও বার্লির যেসব দানা পড়ত তা থেকে গজিয়ে ওঠত চারাগাছ। চারাগাছে পরে দেখা দিত শিষ ও দানা । এ ঘটনা থেকে বীজ ছিটিয়ে খাওয়ার উপযোগী শস্য পাওয়ার ধারণা জন্মে। কৃষিকাজের এ পর্যায়কে বলা হয় উদ্যান চাষ ।
৩. পশুপালন সমাজ : সমাজ বিকাশের ধারায় পশুপালন শুরু হলে সমাজ আরও এগিয়ে যায়। শিকারি মানুষ প্রথমে কুকুরকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করে। কুকুর ছিল বিশ্বস্ত প্রহরী ও শিকারের সঙ্গী। অনেক সময় বুনো ষাঁড়, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, গাধা প্রভৃতি পশু মানুষের হাতে ধরা পড়ত। সেগুলোকে তারা ধরে এনে বেঁধে রাখত । শিকার না মিললে এগুলোকে বধ করে আহার করতো। মানুষ ক্রমে বুঝতে পারে গরু, ছাগল, ভেড়াকে না মেরে এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখলে বেশি লাভজনক হবে। যেমন— প্রতিদিন দুধ ও প্রতিবছর বাচ্চা পাওয়া যাবে, চামড়া ও পশমকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে । এভাবে সমাজে গৃহপালিত পশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তা মানুষের সম্পদে পরিণত হয় ৷ ৪. কৃষিভিত্তিক সমাজ : কৃষিকাজের সূচনা মেয়েরা করলেও লাঙলের আবিষ্কার হওয়ার ফলে পুরুষেরা জমি চাষের দায়িত্ব নেয়। প্রথমে তারা নিজের কাঁধে জোয়াল নিয়ে জমি চাষ করা শুরু করে। কালক্রমে হালের বলদের ব্যবহার শুরু হয়। লাঙল ও হালের বলদ ব্যবহার করে চাষ শুরু হলে উৎপাদন বাড়তে থাকে । কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে সমাজজীবন ও সভ্যতার উন্নতি হতে থাকে। কৃষিকাজের উপযোগী স্থানে লোকসংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মানুষ স্থায়ীভাবে সে স্থানে বসবাস শুরু করে। কৃষিকাজ মানুষের খাদ্যের সংস্থান আরও নিশ্চিত করে। কৃষির উদ্বৃত্ত ফসল সভ্যতার সূচনা করে। এ কারণে বলা হয় সভ্যতা হচ্ছে কৃষির অবদান ।
৫. শিল্পভিত্তিক সমাজ : ইউরোপে মধ্যযুগের শেষদিকে কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়ে যায়। ইউরোপের মানুষ আবিষ্কার করে প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের জ্ঞানবিজ্ঞানের ঐতিহ্য। এটি ইউরোপের নবজাগরণ বা রেনেসাঁ নামে পরিচিত। এ সময়ে ইউরোপের মানুষ বেরিয়ে পড়ে অজানাকে জানতে, পৃথিবীকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাস পৌছে গেলেন আমেরিকায়। ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে নিউটন তুলে ধরলেন তার যুগান্তকারী আবিষ্কার মাধ্যাকর্ষণ। এভাবে শুরু হতে থাকে একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আঠারো শতকে ইংল্যান্ডে বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হলে উৎপাদন ব্যবস্থায় বিপ্লবের সূচনা হয়। এ বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধারণা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা পরপর আবিষ্কার করেন সুতা কাটার স্পিনিং মেশিন, যান্ত্রিক তাঁত, বাষ্পচালিত জাহাজ ও রেলের ইঞ্জিল। এসময় বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হয়। আর স্টিম টারবাইন নামে বিশেষ ধরনের বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এভাবে একদিকে বড় বড় শিল্পকারখানায় উৎপাদন শুরু হয় আর অন্যদিকে দ্রুতগামী জাহাজ ও রেলে ব্যবসা বাণিজ্য ও যোগাযোগের বিস্তার ঘটে। এভাবেই সূচনা হয় শিল্পবিপ্লবের।
৬. শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সমাজ : শিল্পভিত্তিক সমাজে শক্তির উৎস হিসেবে মানুষ ও পশুর স্থান দখল করে যন্ত্র । শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সমাজের মূলভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান ও তথ্য। শিল্পের বদলে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করাই হচ্ছে অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। সম্পত্তির মালিকদের বদলে চাকরিজীবী, বিজ্ঞানী, তথ্য প্রকৌশলী এবং সেবা ও বিনোদন খাতের সাথে যুক্ত মানুষেরাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এবং যোগাযোগের নানা মাধ্যম যেমন ফেসবুক পৃথিবীর মানুষকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বলা হয় সমস্ত পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে বিশ্বায়ন (Globalization)।
৭. উত্তর আধুনিক যুগ : বর্তমানে প্রযুক্তির অসাধরণ উন্নতি এবং বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার বদৌলতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানুষের জীবনকে করেছে অনেক আরামপ্রদ । নতুন মিলেনিয়ামে পদার্পণের ফলে মানুষের চিন্তাচেতনার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে বিশ্বায়নে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা চালু রাখা হচ্ছে। পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সংবাদপত্র, বিভিন্ন মিডিয়া, ইন্টারনেট পৃথিবীতে নতুন সম্ভবনার সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি (১৯৪৫) থেকে বর্তমান ইতিহাসকে উত্তর আধুনিক যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কর্পোরেট বাণিজ্য, অর্থনৈতিক জোট যেমন – EU, EEC, ASEAN বিশ্বব্যাংক, আই এম এফ, ডব্লিও টি-ও (WTO), E-Commerce মিডিয়া, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতিরাষ্ট্র, মানব উন্নয়ন ও মানবতা উত্তর আধুনিক যুগের সংস্কৃতি ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানবসমাজ পরিবর্তনশীল। আজকের দিনে যে সমাজকে আমরা দেখছি, আগের দিনের সমাজ এরূপ ছিল না। মানবসমাজ বিকাশে কতকগুলো ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে। আজকের সমাজ দীর্ঘকালের বিকাশধারার ফল। কালে কালে জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে পুরনো সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে একালের আধুনিক সমাজ গঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতে সমাজ আরও পরিবর্তিত হবে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত