ইতিহাসের কাল নিরূপণ কর। ইতিহাস চর্চায় AD ও BC সংক্ষেপে আলোচনা কর

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও সময়ানুক্রমের মতো সনতারিখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের যেকোনো ঘটনা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হলে ঐ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় বা কার্যকাল অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। কার্যকাল তথা সনতারিখ ব্যতীত ইতিহাস যুগহীন কোনো অনির্দিষ্ট ঘটনার বিবরণে পরিণত হয়ে যায়। সেজন্য ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনাও বিষয়বস্তু উল্লেখ করার সাথে সাথে এর কার্যকাল তথা সময় গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয়। আর এসময় গুরুত্ব বা কাল বিভাজনে AD ও BC এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বলে কালবিভাজনের ক্ষেত্রে AD ও BC অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।
ইতিহাসের কালবিভাজন : ইতিহাসের বোধগম্যতার সুবিধার্থে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীগণ সার্বিক কালের গতিধারাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : ১. প্রাগৈতিহাসিক যুগ, ২. প্রায় ঐতিহাসিক যুগ ও ৩. ঐতিহাসিক যুগ । নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. প্রাগৈতিহাসিক যুগ : প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলতে আমরা একটি এমন সময়কালকে বুঝে থাকি যার সূচনা হয় মূলত পৃথিবীতে মানুষের বসতি স্থাপনের শুরু হতে এবং শেষ হয় আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর পূর্বে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের লিখিত কোনো গ্রন্থের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। কারণ তখন পর্যন্ত লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন না হওয়ায় আমাদেরকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে জানতে সমকালীন জীবাশ্ম, গুহাচিত্র, হাতিয়ার এবং ঐ সময়কালের মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রবাদির ওপর বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয়। সাধারণভাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগকে পাথর যুগ বলেও অভিহিত করা হয় । একেবারে বন্য দশা অতিক্রমের শেষ পর্বে এসে মানুষের প্রথম অগ্রগতির কালকে পাথর যুগ বলে অভিহিত করা হয়। এ যুগের এরূপ নামকরণের কারণ হলো এ যুগে মানুষের শ্রম ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে পাথর । প্রাগৈতিহাসিক যুগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ক. পুরোপলীয় যুগ, খ. মধ্যপলীয় যুগ ও গ. নবোপলীয় যুগ। পুরোপলীয় ও নবোপলীয় যুগের মধ্যবর্তী অল্পকাল স্থায়ী যে যুগের সূচনা হয় তাকে মধ্যপলীর যুগ বলা হয় । পাথরের হাতিয়ারের উন্নয়ন ও স্বার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে সূচনা হয় নবোপালীর যুগের
২. প্রায় ঐতিহাসিক যুগ : প্রোটো ঐতিহাসিক যুগ কথাটির অর্থ প্রায় ঐতিহাসিক যুগ। মূলত প্রাগৈতিহাসিক যুগ ও ঐতিহাসিক যুগের মধ্যবর্তী যুগবিভাজনকে প্রোটো ঐতিহাসিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময়ের সঠিক সূচনা কাল নির্দেশ করা কঠিন। সম্ভবত লিপি আবিষ্কার হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব পনেরো হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার অব্দের মধ্যবর্তী সময়কে প্রোটো ঐতিহাসিক সময়কাল বলা হয়। আবার নবোপলীয় যুগের প্রাথমিক পর্যায়কে প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়। এ যুগে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি ধাতু দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। এ যুগে পশুপালন গ্রামীণ জীবন, বিনিময় প্রথা, ও রাষ্ট্র কাঠামোর প্রাথমিক ভিত্তি গঠিত হয় । এছাড়াও প্রোটো ঐতিহাসিক যুগে তথা তাম্র ব্রোঞ্জ যুগে ধাতুর ব্যবহার, কৃষি ও পশুপালক শ্রেণির উদ্ভব, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশুর ব্যবহার, নদী তীরে গ্রাম গড়ে তোলা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং হাটবাজার গড়ে তোলা হয়। তথাকথিত রাষ্ট্র গঠন ও শাসকশ্রেণির সূচনা প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট বলে বিবেচনা করা হয় ।
৩. ঐতিহাসিক যুগ : প্রোটো ঐতিহাসিক যুগের পর যে যুগ শুরু হয় তাকে ঐতিহাসিক যুগ বলে ধরা হয়। ঐতিহাসিক যুগকে প্রকৃত অর্থে মানব সভ্যতার যুগ বলা হয়। এ ঐতিহাসিক যুগে মানুষ বন্যতা পরিহার করে সভ্য জীবনযাপন শুরু করে। যেসব বৈশিষ্ট্য বা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে পণ্ডিতগণ প্রাগৈতিহাসিক ও প্রোটো ঐতিহাসিক যুগ থেকে ঐতিহাসিক যুগকে স্বতন্ত্র নামে অভিহিত করেছেন সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন ও নগর সভ্যতা গড়ে তোলা। এছাড়াও ঐতিহাসিক যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ কাঠামোর বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা, জাতীয় ধর্ম, নগরায়ণ, মৃৎপাত্র প্রভৃতি উদ্ভাবন হয়। বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা ঘটে। এরমধ্যে খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার থেকে পাঁচ হাজার অব্দে মিসরীয় সভ্যতায় ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। সুমেরীয়তে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার অব্দে ঐতিহাসিক যুগের শুরু হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। বাংলাদেশে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয় ।
• BC ও AD সম্পর্কে আলোচনা : খ্রিস্টপূর্বাব্দ শব্দটির ইংরেজি রূপ হচ্ছে Before Christ আর এ Before Christ কে সংক্ষেপে BC রূপে প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য খ্রিস্ট হতে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ও খ্রিস্টাব্দ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এখানে খ্রিস্ট বলতে খ্রিস্ট ধর্মগুরু যিশু খ্রিস্ট তথা রাসুল ঈসা (আ.) কে মনে করা হয় এবং খ্রিস্টের সাথে অব্দ বা বছর শব্দ যোগ করে খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা খ্রিস্টাব্দ করা হয়েছে। সাধারণত পূর্বাব্দ বলতে পূর্ববর্তী সময় বা বছরকে বুঝায় এবং খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলতে খ্রিস্টের জন্মের পূর্ববর্তী সময় বা বছরকে বুঝানো হয়। উল্লেখ্য খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশু খ্রিস্ট একজন মহামানব ছিলেন । এ মহামানবের পৃথিবীতে আগমনের সময় হতে এক নতুন বছর গণনা শুরু হয়। যা ভারতীয় উপমহাদেশে সাধারণভাবে খ্রিস্টাব্দ নামে পরিচিত। অন্যদিকে, AD কে পূর্ণরূপে Anno Domini (In the year of our lord (Jesus) বলা হয় । Anno Domini এর বাংলা অভিধানিক অর্থ খ্রিস্টাব্দ। অর্থাৎ খ্রিস্টের জন্মের পরে গণনা করা হয় । খ্রিস্ট শব্দের সাথে অব্দ বা বছর শব্দ যোগ করে খ্রিস্টাব্দ করা হয়েছে খ্রিস্টের জন্মের পর হতে খ্রিস্টীয় সন বা খ্রিস্টাব্দ হিসেবে গণনা করা হয় । ক্ষুদ্ররূপে যা খ্রিস্ট + অব্দ (বছর) = খ্রিস্টাব্দ। নিম্নের ছক দ্বারা BC এবং AD সহজেই বোঝা যায়—
খ্রিস্টের জন্মের পূর্ববর্তীকাল
খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা Before Christ (BC)
যিশু খ্রিস্টের জন্ম
খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তীকাল
খ্রিস্টাব্দ বা Anno Domini (AD)
ঐতিহাসিকগণ যিশু খ্রিস্টের আবির্ভাবকে মূল ধরে সমগ্র ইতিহাসের সময়কালকে দুভাগে ভাগ করেছেন। এর প্রথমটি অন্ধকার যুগ, দ্বিতীয়টি হলো আলোর যুগ। অন্ধকার যুগ BC বা Before The Advent of Christ নির্দেশ করে এবং আলোর সময়কে AD দ্বারা বুঝনো হয়। যিশুর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী সময় গণনার ক্ষেত্রে যিশুর জন্মের দূরবর্তী সময়কাল বেশি হবে এবং নিকটবর্তী সময়কাল কম হবে ।
● ইতিহাস চর্চায় AD ও BC এর গুরুত্ব : ইতিহাসের কালবিভাজন, সময়ানুক্রম প্রভৃতি সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে জানার জন্য AD ও BC এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাসের দীর্ঘ ব্যপ্তকালকে হাতের মুঠোয় আনতে, সেই কালের অগনিত তথ্য ও ঘটনাবলির বর্ণনা, বিশ্লেষণ ও বিচার যুক্তি, শৃঙ্খলার সাথে সাজানোর জন্য AD ও BC অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মূলত সঠিক কাল নির্ধারণ ব্যতীত ইতিহাসের ঘটনাবলির কোনো প্রায়োগিক ও বাস্তবিক মূল্য নেই। আর তাই ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস চর্চার ঘটনার সুনির্দিষ্টতা, যথার্থতা ও যুক্তিনির্ভর করে তোলার জন্য কালানুক্রম অর্থাৎ AD ও BC ব্যবহার করে থাকেন। এতে ইতিহাসের যেমন ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তেমনি পঠনপাঠনেও সুবিধা হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসের বিশাল তথ্যভান্ডারকে সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্যভাবে অনুশীলনের জন্য কালবিভাজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কালবিভাজনের মাধ্যমে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ঐতিহাসিক কাল পর্যন্ত মানবসভ্যতার উত্তরণের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাসের ঘটনার কাল নিরূপণ ঐতিহাসিকের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আন্তর্জাতিকভাবে খ্রিস্টীয় কালপঞ্জি ব্যবহৃত হচ্ছে। আর খ্রিস্টীয় কালপঞ্জিকে AD ও BC বিভক্তিকরণ ইতিহাস জ্ঞানকে ধারাবাহিকতার বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]