ইতিহাসের প্রধান শাখাসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

উত্তর ভূমিকা : মানুষের কর্ম বিস্তৃতির ওপর ইতিহাসের শাখাপ্রশাখার বিস্তৃতি নির্ভর করে। সময় অতিক্রমের সাথে সাথে মানব সভ্যতা ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। যে কারণে মানুষ তাদের কর্মকে সুষ্ঠুভাবে চিহ্নিত করার জন্য নানা ভাগে বিভক্ত করছে। মানুষের কর্মের বিভক্তির কারণে বিষয়বস্তুগতভাবে ইতিহাস বহু শাখা ও উপশাখায় বিভক্ত হয়েছে। তবে ইতিহাসের শাখাগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত ।
● ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শাখা : বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ইতিহাসকে মূলত নিম্নরূপ শাখাসমূহে বিভক্ত করা যায় । যথা : ১. রাজনৈতিক ইতিহাস, ২. সামাজিক ইতিহাস, ৩. অর্থনৈতিক ইতিহাস, ৪. ধর্মীয় ইতিহাস, ৫. সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ৬. ভৌগোলিক ইতিহাস, ৭. নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস ও ৮. প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস ।
নিম্নে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো :
১. রাজনৈতিক ইতিহাস : ইতিহাসের সব শাখার মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যতম। ইতিহাসের আলোচনার একটা বৃহৎ অংশজুড়ে আছে বিভিন্ন শ্রেণির রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। যেমন— প্রাচীনকালের রাজাগণ, তাদের রাজত্বকাল, যুদ্ধজয়, জনহিতকর কার্যাবলি, জনগণের সাথে রাজার সম্পর্ক নগর রাষ্ট্র প্রভৃতি। মধ্যযুগে এসে জনগণ ও ব্লাজা, রাজতন্ত্র প্রভৃতি ইতিহাসের রাজনৈতিক শাখায় অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে । এ সময়কালের নগররাষ্ট্রের শাসনকার্যে জনগণের অন্তর্ভুক্তি, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের গঠন ও রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বিধানের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। আধুনিককালে রাজনৈতিক ইতিহাস একটি বহুমাত্রিক রূপ পায়। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ্বব্যবস্থা, শক্তি সামর্থ প্রভৃতি রাজনৈতিক ইতিহাস সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। আর এজন্য বলা হয় রাষ্ট্র, রাজনীতি ও প্রশাসকসমূহের কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করেই রাজনৈতিক ইতিহাস প্রণীত হয় ।
২. সামাজিক ইতিহাস : ইতিহাসের শাখাসমূহের মধ্যে সামাজিক ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের মধ্যে সমাজের পরিধি সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক। সামাজিক পরিমণ্ডলের মধ্যে সংঘটিত, সম্পাদিত ও অনুষ্ঠিত সব বিষয়ের অর্থভিত্তিক ও লিখিত বিবরণের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। সামাজিক পরিধির মধ্যেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়। বৃহত্তর অর্থে অন্যভাবে বলা যায়, যে ইতিহাস সমাজের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, উদ্দেশ্য, সামাজিক সংগঠন, সামাজিক শ্রেণিভেদ ও বৈষম্য, সমাজে বসবাসকারী মানুষের এরূপ বিভিন্ন দিক তুলে ধরে যা সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত। সমাজের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক ইতিহাসের পরিধিও বিস্তৃত হচ্ছে। ইতিহাসের অন্যান্য শাখার ন্যায় সামাজিক ইতিহাসেরও শাখা উপশাখা রয়েছে। যেমন— মাতৃতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ইতিহাস, সমাজের বর্ণ বৈষম্যের ইতিহাস, সমাজের যাজক সম্প্রদায়ের ইতিহাস প্রভৃতি । ৩. অর্থনৈতিক ইতিহাস : সম্পদের উৎপাদন, সংরক্ষণ, উদ্দেশ্য ও প্রকৃত ব্যবহারকে কেন্দ্র করে ইতিহাস নির্ভর জ্ঞানের যে শাখা গড়ে ওঠেছে তাকে অর্থনৈতিক ইতিহাস বলে । প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সম্পদ মানুষের জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ইতিহাস এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ সাম্যবাদী অর্থনীতি অনুসরণ করতো। মনের অজান্তেই তখনকার অর্থনীতির মূল বিষয় ছিল খাদ্য সংগ্রহ করা। প্রাচীন যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষ দিক হলো দাস শ্রমভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং মুদ্রা অর্থনীতির শুভসূচনা করা। এ সময় দাস শ্রমকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদন ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসার ঘটানো হয় । প্রাচীন যুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণ, রৌপ্য প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ।
৪. ধর্মীয় ইতিহাস : ধর্মের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আচারানুষ্ঠান, ধর্মের পরিবর্তন, সংস্কার, ধর্মকে কেন্দ্র করে নানাবিধ যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে যে ইতিহাস রচিত হয় তা ধর্মীয় ইতিহাস নামে পরিচিত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ধর্ম মানুষের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে আসছে। পুরোপলীয় যুগের মানুষ টোটেম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। এরপর নবপোলীয় যুগের মানুষ সাধারণত অনিষ্টকারী ও কল্যাণকারী নানাবিধ

ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা
প্রাকৃতিক শক্তির ওপর দেবত্ব আরোপ করতে থাকে। উপর্যুক্ত উভয় যুগের মানুষ পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতো । বর্তমান সময়ে একত্ববাদই ধর্মীয় ইতিহাস (বিশেষত মুসলমান), হিন্দু ধর্মের ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মীয় ইতিহাস, গৌতম বুদ্ধকেন্দ্রিক ধর্মীয় ইতিহাস বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে ।
৫. সাংস্কৃতিক ইতিহাস : মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবনযাপন পদ্ধতি, দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অনুসঙ্গ প্রভৃতি সংস্কৃতি, আবার সংস্কৃতি বলতে প্রধানত বিনোদনমূলক কার্যক্রমকে বুঝানো হয়ে থাকে । যেমন— গানবাজনা, নৃত্য, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা প্রভৃতিকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বলে অভিহিত করা হয় । কিন্তু বৃহত্তর অর্থে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বলতে শুধু উপর্যুক্ত বিনোদনমূলক কার্যক্রমকে বুঝায় না। একজন মানুষ বা একটি জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় তথা সামগ্রিক আচরণিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি নামক অভিব্যক্তির প্রতিফলন ঘটে থাকে । সুতরাং ইতিহাসের যে শাখা প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানুষের স্থাবর-অস্থাবর সব অর্জন ও বিনোদন ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে তাকে সাংস্কৃতিক ইতিহাস ।
৬. ভৌগোলিক ইতিহাস : ইতিহাস ও ভূগোল পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত । ভূগোল ছাড়া ইতিহাস পরিপূর্ণতা করতে পারে না । ‘ভূ' শব্দটির অর্থ ‘পৃথিবী’ এবং ‘গোল' শব্দটির অর্থ গোলাকার, অর্থাৎ ভূগোল শব্দটির দ্বারা গোলাকার পৃথিবীকে বুঝানো হয় । . আর ভৌগোলিক ইতিহাস বলতে মূলত গোলাকার পৃথিবীর ইতিহাসকে বুঝানো হয়। কিন্তু যথাযথভাবে ভৌগোলিক ইতিহাস বলতে ভূপ্রকৃতি, কোনো অঞ্চল বা দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা দেশ ও জনগণের ওপর সেখানকার ভূপ্রকৃতির প্রভাব, আবহাওয়া ও জলবায়ুর অবস্থা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে যে ইতিহাস রচিত হয় তাকে বুঝানো হয় । ৭. নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস : নৃশব্দটির সাধারণ অর্থ মানুষ । কাজেই নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বলতে সাধারণত মানুষ, মানুষের জীবনাচরণ প্রভৃতির তত্ত্বগত ইতিহাসকে বুঝানো হয়। কিন্তু যথাযথ অর্থে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বলতে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আদি পরিচয়, উদ্ভব, ক্রমবিকাশ, রীতিনীতি, বংশগত ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত সত্তাভিত্তিক ইতিহাসকে বুঝানো হয়ে থাকে। গুরুত্বের নিরিখে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বর্তমানে শুধু ইতিহাসের একটি শাখা হিসেবেই থেমে থাকেনি, ব্যাপকভাবে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস চর্চা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাকে 'নৃতত্ত্ব বিভাগ' (Anthropology Department) নামে পৃথক বিভাগের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ফলে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসচর্চা আরও বেগবান হবে এমনটা প্রত্যাশা করাই যায় । ৮. প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস : প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ইতিহাসের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যে কারণে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস এখন শুধু ইতিহাসের একটি শাখা হিসেবেই থেমে নেই। এখন এ বিষয়টি অধিক গুরুত্ব সহকারে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের মর্যাদা পেয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের লিখিত কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি বিধায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস মূলত প্রত্নতত্ত্ব নির্ভর। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস বলতে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসকে বুঝানো হয়ে থাকে । প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন পাথরের অস্ত্র, গুহাচিত্র, কুমারের চাকা, মাটির পাত্র, জীবাশ্ম প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর গবেষণা করে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস জ্ঞানকে আরও বিস্তৃত, কাঠামোবদ্ধ ও সহজবোধ্য করে তোলার ক্ষেত্রে ইতিহাসের শাখা বিভাজন ঐতিহাসিকগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত । জ্ঞান হিসেবে ইতিহাসের তথ্য বিভিন্ন শাখা থেকে গ্রহণ করলেও ইতিহাস হলো এক ও অভিন্ন। তবে ইতিহাসের এ শাখা বিভাজন যেন কোনোভাবেই ইতিহাসের মৌলিক ঐক্যের পরিপন্থি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাহলেই ইতিহাস চর্চা দেশ ও জাতির উন্নতির পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]