রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু আলোচনা কর ।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাসের যেসব শাখা গড়ে উঠেছে তার মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং অধিক পঠিত। প্রাচীন যুগের যেসব জীবনচরিত, প্রশস্তি, যুদ্ধ বিগ্রহ এবং চুক্তি সম্পর্কে দলিলপত্র লিখিত হয়েছে এর সবই রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্তর্গত এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শের ইতিহাস বা চিন্তাধারাকেও রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয় হিসেবে মনে করা হয়। যে সর্বোচ্চ মতাদর্শের দ্বারা রাষ্ট্র নামক সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনাসহ এর জনগণকে সংঘটিত ও সুবিন্যস্ত করা হয় তাকে রাজনৈতিক এবং এর অতীত বিবরণ রাজনৈতিক ইতিহাস বলে অভিহিত করা হয় ।
রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু : নিম্নে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তুসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. রাজার গুণকীর্তন :- রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজা, রাজার কর্মকাণ্ড, রাজবংশের বিবরণ ইত্যাদি সন্নিবেশিত করা হয়। রাজনৈতিক ইতিহাসের আরও একটি বিশিষ্ট দিক হলো রাজার কর্মকাণ্ডের প্রশংসা। রাজার অনুগত ব্যক্তি বা সভাকবিদের দ্বারা রচিত রাজনৈতিক ইতিহাসেই রাজার গুণকীর্তন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আবার রাজার জনহিতকর কার্যাবলি, বীরত্বসূচক কাহিনিসমূহও রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে। যেমন— আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বের কথা বলা যায় । যেখানে সত্যিকার অর্থেই রাজা প্রভূত গুণের অধিকারী ছিলেন ।
২. যুদ্ধের কাহিনী : রাজনৈতিক ইতিহাস রাষ্ট্র বা জনপদের পারস্পরিক বহুমাত্রিক যুদ্ধের বিস্তৃত কাহিনী আমাদের সামনে তুলে ধরে। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের কাহিনি, যুদ্ধে তাদের বীরত্ব, তাদের অর্জন, বর্তমান কালের বড় ছোট সব যুদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। যেমন— রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ইংল্যান্ড দখল করে বলেছিলেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। সিজারের ইংল্যান্ড জয়ের কাহিনী পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসকে যেমন রোমাঞ্চিত করেছে তেমনি করেছে সমৃদ্ধ। এ ঘটনাসহ এরূপ সব ঘটনা প্রবাহই রাজনৈতিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
৩. প্রশাসনিক কাঠামোর ধারণা : রাজনৈতিক ইতিহাসে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোও আলোচিত হয়। প্রত্যেক রাজা বা প্রশাসনেরই শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো আদর্শ থাকে। রাজা সেই আদর্শ অনুসরণ করেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজার রাষ্ট্র শাসনাদর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পায়। যেমন : আমরা জানি সম্রাট আকবরের রাষ্ট্র শাসনাদর্শ ক্ষেত্র বিশেষে অনুসরণীয় ছিল। যা মুঘল আমল তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগের প্রশাসনিক কাঠামোর ধারণা দেয় ।
৪. রাজনৈতিক চালচিত্র : রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়বস্তু হিসেবে রাজনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দেয় । প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়লে একটি কথা বারবার আসে তা হলো গুপ্তযুগে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। ফলে তখন ভারতীয়দের মধ্যে উন্নতমানের শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। এ সময়কালে ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক কাঠামোর স্থিতিশীলতা ছিল। উক্ত স্থিতিশীল পরিবেশ সাহিত্য বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। তাই রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে রাজনৈতিক চালচিত্র আলোচিত হয়।
• সামাজিক ইতিহাসের উৎস : মানব সংস্কৃতির তথ্যই হচ্ছে ইতিহাসের উৎস। ইতিহাসবিদগণ এ উৎস থেকেই অতীত সমাজজীবনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। নিম্নে সামাজিক ইতিহাসের উৎস্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার : প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় । পুরনো দিনের নগর ও রাজধানীর ভগ্নাবশেষের মধ্যে আমরা অতীত মানুষের জীবন প্রণালি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান, ধর্মবোধ ইত্যাদির পরিচয় পেয়ে থাকি। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদ, মন্দির, লিপি, মুদ্রা, দেবদেবীর মূর্তি, হাতিয়ার, আসবাবপত্র, স্মৃতিফলক ইত্যাদির মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি ।
ক. রাজপ্রাসাদ ও মন্দির : প্রাচ্য সভ্যতার অতীত নিদর্শন মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, তক্ষশীলা, মহাস্থানগড়, ময়নামতি, পাহাড়পুর প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া যায়। এসব স্থানে রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ যেমন পাওয়া গেছে তেমনি তাদের ধর্মবোধ সম্পর্কেও জানা গেছে ।
খ. লিপি : প্রাচীন যুগে কাগজ ছিল না। সে কারণে মানুষ তার মনের কথা, তথ্যাবলি, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পাথর, পর্বতগাত্র, তামারপাত্র ইত্যাদিতে বিশেষ লিপির মাধ্যমে লিখে রাখতো। বিশেষ করে রাজ্য শাসন প্রণালি সম্পৰ্কীয় বিষয়াবলি লিপির মাধ্যমে কঠিন পর্বতগাত্রে খোদিত করে রাখা হতো ।
গ. মুদ্রা ও দেবদেবীর মূর্তি : মুদ্রার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজার রাজত্বকাল, শাসকদের নাম ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় । দেবদেবীর মূর্তি থেকে মানুষের জীবনধারার নির্দেশনা, ধর্মীয় চিন্তাধারা ও শিল্প নিপুণতার পরিচয় পাওয়া যায় ।
ঘ. আসবাবপত্র ও হাতিয়ার : আসবাবপত্র ও হাতিয়ার দেখে যুগকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন— প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, বোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। এসব ধাতুর মাধ্যমে সে যুগের অস্ত্র তৈরি করা হতো। মানবসমাজে কীভাবে পরিবর্তন এসেছে আমরা এ হাতিয়ার দেখে তার ধারণা লাভ করতে পারি ।
ঙ. স্মৃতিফলক : স্মৃতিফলক দেখে অতীত জীবনধারা সম্পর্কে জানতে পারা যায়। আর. এল, ব্রাইন এর মতে, “স্মৃতিফলক জীবনধারার সাক্ষী, সমাজচিত্রের দর্পণ এবং মানুষের পেশা ধারণার অবলম্বন ।
২. পৌরাণিক কাহিনি : বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে সামাজিক ইতিহাসের উপাদান আছে। এগুলো সামাজিক ইতিহাসের চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। সামাজিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে সাহিত্যিক গ্রন্থও বিবেচনার যোগ্য ।

পরিব্রাজকদের ভ্রমণকাহিনি : অতীতকালে ভ্রমণকারীগণ এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে সেদেশের আচার আচরণ, জীবন প্রণালি ইত্যাদি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন ।
● সামাজিক ইতিহাসের উৎসমূহের গুরুত্ব : সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহ বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের গুরুত্ব : প্রাগৈতিহাসিককালের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের তেমন কোনো লিখিত উপাদান পাওয়া যায়নি। আর তাই প্রাগৈতিহাসিক বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাস জানার জন্য আমাদেরকে সামাজিক ইতিহাসের উৎসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। যেমন— মিসরীয় নিদর্শনাদির ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি মিসরীয় সভ্যতার অধিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবন কেমন ছিল। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে ঐতিহাসিকগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সিন্ধুর মানুষের জীবনে ধর্মের তেমন প্রভাব ছিল না। কারণ সিন্ধু সভ্যতায় কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিদর্শন পাওয়া যায়নি ।
সামাজিক ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎসের মধ্যে মুদ্রা, লিপি আমাদের পূর্ব পুরুষদের অর্থনৈতিক কার্যাবলি এবং তাদের ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেয় । যা বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
২. ঐতিহাসিক উৎসের গুরুত্ব : বিভিন্ন পৌরাণিক লোককাহিনি, যেমন— বেদ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি প্রাগৈতিহাসিক কালে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা দিক নিয়ে আলোচনা করে। এতে আমরা প্রাগৈহাসিক কাল থেকে প্রাচীনকাল পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের মনুষ্য সমাজ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি ।
৩. পরিব্রাজকদের বিবরণীর গুরুত্ব : চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিং, ইবনে বতুতা প্রমুখ পরিব্রাজকের আগমনের ফলে তাদের দ্বারা বাংলার ইতিহাস বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাদের রচনায় বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক জীবন প্রণালি ওঠে এসেছে । এতে করে আমরা আমাদের প্রাচীন ইতিহাস জানতে পারছি সামাজিক ইতিহাসের উৎসসমূহ থেকে । উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক ইতিহাস জানতে হলে উপরোক্ত উৎসগুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। সামাজিক ইতিহাস এবং এর উৎসসমূহ বাংলাদেশের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসের এবং প্রাচীন ইতিহাসের লিখিত বিবরণ খুব একটা না থাকায় আমাদেরকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় । না হলে হয়তো আমরা আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক সম্পর্কে জানতেই পারতাম না ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]