উত্তর ভূমিকা : মানুষের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের সাথে তাল রেখে ইতিহাসও বহুমুখী ও বহু শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা ইতিহাস মানুষের অতীত কর্মকাণ্ডের দলিল হিসেবে কাজ করে। মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সামাজিক ইতিহাস নামক শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তেমনিভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক ইতিহাস ইত্যাদি নামে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাসে এরূপ শাখা বিভক্তির ফলে আলাদাভাবে মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ।
ইতিহাসের বিভিন্ন শাখা
" ইতিহাসের শাখা হিসেবে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের বিবরণ : ইতিহাসের শাখা হিসেবে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস আলোচনা করা হলো :
ক. ইতিহাসের শাখা হিসেবে রাজনৈতিক ইতিহাস : একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাজনীতি চালিত হয় এবং রাজনীতিবিদরা তাদের দলের নির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে থাকেন। এ জন্য রাজনীতি বিজ্ঞান ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত বিষয় বলে বিবেচিত। তাই ইতিহাসের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বা পরিধি বর্তমানে অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইতিহাসের যেসব শাখা আমাদের নিকট জনপ্রিয় সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। কোনো দেশ বা অঞ্চলের রাজনৈতিক বিষয়াবলি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। প্রাচীন যুগে মানবসমাজে যেসব টোটেম ও ট্যাবু গড়ে ওঠেছিল এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে ঐক্যবোধ লক্ষ করা গিয়েছিল এর মধ্যে রাজনীতি জ্ঞান সবচেয়ে সক্রিয় ছিল ।
ঐতিহাসিক জি. এন. ক্লার্ক (G.N. Clark) বলেন, "It is the public institutions that men express their will to control events and therefore."
ঐতিহাসিক পিরেন, ভলতেয়ার, গিজো, অগাস্টিন থিয়েরি, মেকোউলে, ড্রইজেন, র্যাংকে প্রমুখ রাজনৈতিক ইতিহাসকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তারা রাষ্ট্রকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা
করা হলো :
১. রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু : একদা রাজনৈতিক ইতিহাসের বিষয়বস্তু ছিল অতীতকালের রাজাদের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, বিভিন্ন সন্ধি, চুক্তি। যুদ্ধ জয়ের কাহিনি, রাজ্য জয় প্রভৃতি। যারা অতীতের রাজা বাদশাদের রাজত্বকালের কাহিনি সুন্দর করে জনসম্মুখে বলতে পারতেন সাধারণ জনগণ তাদের অত্যন্ত সমাদর করতো । প্রাচীনকালে রাজাদের কার্যাবলি এবং যুদ্ধ সাধারণ মানুষের ভাগ্যকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো। যুদ্ধে জয়-পরাজয়, রাজার ভাগ্যোন্নয়ন ও ভাগ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকত। প্রাচীনকালে যুদ্ধ জয় রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে পরিগণিত হতো। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সম্পদ লাভ, রাজ্য বিস্তার, ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি যুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। এখনো বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান পতনে যুদ্ধ এক বিশেষ কারণ হয়ে থাকে ।
২. রাজনৈতিক ইতিহাসের উপযোগিতা : রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শাসননীতি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ ঠিক কী কারণে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দখল করার জন্য সংগ্রাম করে রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে তা সঠিকভাবে জানা যায় এবং এখনো রাজনীতি মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাজনীতিবিদরা এখনো রাষ্ট্রের জন্য কোনটি ভালো বা কোনটি মন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কোন ব্যবস্থাটি উন্নয়নের জন্য কিংবা শাসনের জন্য অধিক কার্যকর তার তুলনামূলক বিচার ইতিহাসের আলোকেই করে থাকেন। তাই ক্রমেই রাজনৈতিক ইতিহাস ইতিহাস শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
খ. ইতিহাসের শাখা হিসেবে সামাজিক ইতিহাস : ইতিহাসকে সমাজের দর্পণ বলা হয় এবং সমাজবদ্ধ মানুষের কার্যাবলির পরিমাপক হলো ইতিহাস, যা সমাজের চলমান ধারায় সমাজজীবনে প্রতিফলিত হয়। রাষ্ট্রের মধ্যে সমাজের পরিধি সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক । অবশ্য সামাজিক পরিধির মধ্যেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত ও সম্পাদিত হয়। ব্যাপক অর্থে সামাজিক পরিমণ্ডলের মধ্যে সংঘটিত, সম্পাদিত ও অনুষ্ঠিত সব বিষয়ের তথ্যভিত্তিক ও লিখিত বিবরণের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক ইতিহাস গড়ে ওঠে ।
নিম্নে সামাজিক ইতিহাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
১. পরস্পর নির্ভরশীলতা : সামাজিক ইতিহাস মূলত সংঘবদ্ধ মানবগোষ্ঠীর ইতিহাস। প্রাগৈতিহাসিক কালে বিভিন্ন প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ সংঘব্ব হয়ে সমাজ গঠন করেছিল। সমাজবদ্ধ এ মানবগোষ্ঠী নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজনে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যেমন— আমরা বর্তমান সমাজব্যবস্থায়ও দেখতে পাই কোনো ব্যক্তি এককভাবে নিজের সব প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হয় না। বাধ্য হয়ে মানুষকে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। এরূপ
পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই আমাদের সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে। মানুষে মানুষে এরূপ নির্ভরশীলতা না থাকলে হয়তো মানবসমাজ এতদিনে বিলীন হয়ে যেত। আর তাই সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য পারস্পরিক নির্ভরশীলতা । আর এ নির্ভরতা থেকেই জন্ম নিয়েছে সামাজিক ঐক্য বা মানবসমাজে আজও বিদ্যমান ।
২. সহযোগিতামূলক মনোভাৰ : সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সামাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব বিদ্যমান থাকা। প্রতিটি মানুষ যেমন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল তেমনি এ নির্ভরশীলতার অপর পিঠে মানুষে মানুষে সহযোগিতামূলক মনোভাবের চিত্রও দেখা যায়। ফলে সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠে। এ নির্ভরশীলতা ও বিশ্বাস সমাজ বিকাশের
রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করে।
৩. সামাজিক নেতৃত্ব : সমাজ গঠনের শুরু থেকেই অনেক মানুষ একসাথে মিলেমিশে বসবাস করার ফলে মানবসমাজ বিকশিত হয়েছিল । সময়ের প্রেক্ষিতে এ সমাজের আকার আকৃতি বাড়ার পাশাপাশি এর কর্মপরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত আঙ্গিকের এ সমাজব্যবস্থায় নিয়মশৃঙ্খলা, মিলেমিশে থাকা ও সমবণ্টনের প্রয়োজনের তাগিদেই এক সময় এক বা একাধিক ব্যক্তির নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। সামাজিক নেতৃত্বের গুণাবলি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক নানা বিষয় নিয়েও সামাজিক ইতিহাস আলোচনা করে থাকে ।
৪. সামাজিক প্রথা ও আইন : সমাজে বসবাসকারী মানুষ এক সময় বিভিন্ন কারণে নানা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বন্দ্ব ও এগিয়ে যাওয়ার নানামুখী প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করে। অপরের সম্পদ হরণ, লুটতরাজ, চুরি, প্রভৃতি বিষয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সমাজে দানা বেঁধে উঠতে থাকে । সংঘবদ্ধ মানুষ যেখানে সমাজ গঠিত হওয়ার প্রথম ও প্রধান উপাদান, সেখানে এ ধরনের অপরাধমূলক মানসিকতা মানুষের একসাথে মিলেমিশে বাস করার ধারণাকে হুমকির মুখে ফেলে। এসব অন্যায় অরাজকতা থেকে মানবসমাজকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক প্রথা ও আইনকানুন তৈরি করা হয়েছিল। যা আজও আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিশেষভাবে যে দুটি দিক প্রধান্য পেয়ে থাকে তাহলো সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর এ দুই ধরনের কর্মের ভিত্তিতে ইতিহাসের যে দুটি শাখা বিভাজন তা ইতিহাসকে আরও সহজবোধ্য করে তুলেছে। ইতিহাসবিষয়ক আলোচনায় এরূপ শাখা বিভাজন ইতিহাসের মৌলিক ঐক্যের পরিপন্থি হলেও তা সময়ের নিরিখে প্রয়োজনীয় । শুধুমাত্র পঠনপাঠনের সুবিধার্থে ইতিহাসের এরূপ শাখা বিভাজন করা হয়েছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত