ইতিহাসের পরিচয় উল্লেখপূর্বক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।

উত্তর ভূমিকা : ইতিহাস মানুষের অতীত কর্মের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ, যা লিখিত অবস্থায় উপস্থাপন করা হয়। মানবসমাজের অতীত বিবরণের মধ্যে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনধারাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। সংস্কৃতি নামক অভিব্যক্তিটি কখনো পৃথকভাবে আবার কখনো সামগ্রিকভাবে প্রকাশ লাভ করতে পারে। ইতিহাসের সাংস্কৃতিক আলোচনায় মানুষের জীবনযাত্রা, সামাজিক জীবন, ভাষা, শিক্ষা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জীবনে সার্বিক দিকের প্রসারণ ঘটায় ।
ইতিহাসের সংজ্ঞা : ইতিহাস কী তা এক কথায় বলা কঠিন। কারণ অনেক পণ্ডিতই ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের মতো করে মত দিয়েছেন। তাই সহজেই একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় পৌঁছা যায় না। তবে পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতসমূহ বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের একটি সাধারণ সংজ্ঞা তৈরি করা সম্ভব। অতীতে যা কিছু ঘটেছে সাধারণভাবে তাকেই ইতিহাস বলা হয় । কিন্তু অতীতের সব কিছুকেই ঢালাওভাবে ইতিহাস বলা যায় না। শুধুমাত্র অতীতের যে সমস্ত ঘটনা প্রবাহ মানুষের দ্বারা নির্মিত, ও সংঘটিত বলে জানা যায় তার সত্যনিষ্ঠ লিখিত বিবরণকেই ইতিহাস বলা যায় ।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা নিচে দেওয়া হলো :
ইতিহাসের জনক গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস ( Herodotus) বলেন, “ইতিহাস হলো অতীত ঘটনার সত্য ও সুন্দর বর্ণনা ।”
ঐতিহাসিক আর.জি. কলিংউড (R. G. Collingwood) এর মতে, “অতীত শুধু অতীত বলেই ইতিহাসের বিষয়বস্তু নয় বরং সেই অতীতই ইতিহাস যার সাক্ষ্যপ্রমাণাদি আমাদের হাতে আছে।”
ভি.ডি. গ্যাট (V. D Ghate) এর মতে, ইতিহাস হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত পাঠ এবং মানবজাতির সম্পূর্ণ অতীতের একটি জীবন্ত প্ৰমাণ চিত্র ।
ই. এইচ. কার (E. H Curr) বলেন, “ইতিহাস কী প্রশ্নের জবাবে আমার প্রথম বক্তব্য : এটা ঐতিহাসিক ও তথ্য উপাত্তের মধ্যকার নিরবচ্ছিন্ন ক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ।”
● সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
১. মানুষের জীবনযাত্রা : মানুষ জীবনধারণের জন্য প্রধানত প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। পরবর্তীকালে প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থানের সঙ্গে লড়াই করে মানুষ অনেক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্রকৃতিকে সাধারণত মানুষের বশে আনার কারণে বিকশিত হয় সংস্কৃতি। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতি। তাই বলা যায়, মানুষের জীবনযাত্রার বিস্তৃত দিক তুলে ধরে সংস্কৃতি ।
২. সামাজিক জীবন : মানুষ বিশেষ প্রয়োজনেই একত্রিত হয়ে বসবাস করতে শুরু করে বলে মানুষ নিয়ে বিকশিত হয় মানবসমাজ ধারাবিবরণী। মানবসমাজের প্রতিটি কার্যক্রমই মানুষের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোচনায় যেসব অনুযঙ্গ গুরুত্বের সাথে স্থান পায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবন প্রণালি। সাংস্কৃতিক ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে তাই মানুষের সামাজিক জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।
৩. ভাষা : মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে গিয়ে বিকাশ ঘটিয়েছে তার সমাজজীবনের। একসঙ্গে মিলেমিশে অনেক মানুষ বাস করতে গিয়ে একে অন্যের সাথে ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসেবে ভাষার প্রচলন করেছে। তাই সমাজ জীবনে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। জীবনধারণের প্রয়োজনে সমাজে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষ একে অন্যের সঙ্গে তার মনের ভাব আদানপ্রদানের জন্য ভাষা ব্যবহার করছে। সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে তাই ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
৪. শিক্ষা : প্রাগৈতিহাসিক কালের গুহাবাসী মানুষ একমাত্র শিক্ষার বদৌলতে আজ আধুনিক সভ্যতা বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। যে জাতি যত শিক্ষিত তার সংস্কৃতি ততই উন্নত। কারণ শিক্ষা সংস্কৃতির বাহন হিসেবে কাজ করে। এখন মানুষ নিজে শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের সন্তানদের শিক্ষিত করাতে চেষ্টা করছে। তাই বলা যায়, সংস্কৃতির ক্রমউন্নতিতে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ।
৫. সাহিত্য : মানুষ তার জীবনধারণের প্রয়োজনীয় চাহিদাসমূহ মেটানোর পর নিজের ও আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেছিল। পাশাপাশি ধর্মবিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে মানুষ সাহিত্য সৃষ্টি করে । সাহিত্যে মানুষের সহজাত রুচিবোধের প্রকাশ ঘটে। মানুষের সৃজনশীলতারও বিকাশ ঘটে সাহিত্য রচনার মাধ্যমে । কোনো দেশে বা সমাজের সাহিত্য পাঠ করে উক্ত সমাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায় । কেননা সাহিত্যের মধ্যেই মানুষের সংস্কৃতির সব দিক বিস্তারিত আলোচিত হয় ।
৬. চিত্র ও শিল্পকলা : পাথর যুগ থেকেই সুন্দর ও সৃষ্টির পূজারি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করার ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময় বের করার কথা ভাবতে থাকে। এ অবসর সময়ে মানুষ তৈরি করতে শুরু করেছে নানা ধরনের মূর্তি আর বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্ম। চিত্র ও শিল্পকলার বিকাশ মানুষের সংস্কৃতির ক্রমপ্রগতিতে একটি মাইল ফলক। সুন্দরের প্রতি নিরন্তর আগ্রহের কারণে মানুষ তার মনের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে নানা শিল্পকর্মে। শিল্পকর্ম অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মনের চাওয়াপাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে এ বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই সাংস্কৃতিক ইতিহাস আলোচনার ক্ষেত্রে চিত্র ও শিল্পকলাকে স্থান দেয়া হয়েছে।
৭. ধর্মবিশ্বাস : মানুষের ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রায়শই একসূত্রে গাথা। মানুষের ধর্মবিশ্বাস অনেক ক্ষেত্রে তার সংস্কৃতিকে তাড়িত করে। অজানা একটি দৈব শক্তির প্রতি অগাধ বিশ্বাস মানুষকে তার সংস্কৃতি বিকাশে নানাভাবে তাড়িত করেছে। আর তাই সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে শ্রেণি বিভাজন তৈরি হয়েছে। যেমন— ইসলামি সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি প্রভৃতি এ ধরনের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিশ্বাস সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাসের কিছুটা প্রতিবন্ধক হলেও উদার নৈতিক দেশসমূহে সর্বজনীন ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্কৃতি পাশাপাশি বিরাজমান ।
৮. খাদ্যাভ্যাস : সংস্কৃতি অনেকক্ষেত্রেই আমাদের খাদ্যাভ্যাসের নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কৃতি এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে গভীরভাবে । বাঙালিরা সাধারণত ভাত, মাছ ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে তাই হয়তো আমাদের দেশে পান্তা ইলিশের সাংস্কৃতিক ধারা তৈরি হয়েছে। এরূপ ধর্মবিশ্বাসকেন্দ্রিক সংস্কৃতি খাদ্যাভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
৯. পোশাক পরিচ্ছদ : আমাদের পোশাক পরিচ্ছদে সংস্কৃতি গভীর ছাপ পড়ে থাকে। সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পোশাকে তৈরির ধরন, অলংকারিক সৌন্দর্য, সৃষ্টিশীলতা প্রভৃতিতে বৈচিত্র্য এসেছে। যেমন— পহেলা বৈশাখে, কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে বরকনেসহ অনেককেই পাঞ্জাবি-পাজামা ও শাড়ি পরিধান করতে দেখি। এতে বুঝা যায়, সংস্কৃতি আমাদের পোশাক পরিচ্ছদে গভীর প্রভাব বিস্তার করে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাস যেমন মানুষের অতীত কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে তেমনি সংস্কৃতিও মানুষের অতীত জীবনবোধ, নীতি, বিশ্বাস, বিনোদন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয় । এদিক দিয়ে ইতিহাস ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। তাই ইতিহাসে সংস্কৃতি প্রত্যয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের দৈনন্দিন দিনযাপনসহ সব ক্ষেত্রেই সংস্কৃতি বিদ্যমান । তাই বলা যায়, সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ে আলোচনা করা

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]