চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? বাংলার অর্থনীতি ও সমাজের উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি প্রভাব বিস্তার করেছিল?

চার্লস স্টুয়ার্টের পরিকল্পনার কিছুদিন পরে কোম্পানি দেখলেন যে, ভারতে কোম্পানির রাজস্ব নিয়ে যে সমস্যা তা সমাধান করার একমাত্র উপায় হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মাধ্যমে রাজস্ব সমস্যা সমাধান করা। তাই ১৭৮৬ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টরস রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে পাঠান। কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসেই রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরী করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু এ কার্যে তাঁর কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা ও বোর্ড অব রেভিনিউর প্রেসিডেন্ট জন শোর। জন শোর মতামত ব্যক্ত করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার পূর্বে জানা দরকার :
১. জমিদার, তালুকদার ও রায়তের বর্তমান আর্থিক অবস্থা। ২. মুঘল শক্তির অবক্ষয়ের আগে জমিদার ও রায়তের অধিকার।
৩. মুঘল শক্তির পতন পর্বে রায়তের খাজনা সংক্রান্ত আইন ।
দেওয়ানি লাভের পর জমিদার কর্তৃক আরোপিত নতুন আবওয়াব, মামথ ইত্যাদি ।
৪. ৫. সাধারণ রায়তের স্বার্থরক্ষার উপায়।
৬. বর্তমান রাজস্ব ধার্য ব্যবস্থার ত্রুটিসমূহ দূর করার উপায় ।
৭. ১৭৭২ সাল থেকে প্রত্যেক জমিদারির বিস্তারিত জমা, উশুল ও বাকি হিসাব সংগ্রহ। এ ধরনের মতানৈক্য চলাকালে লক্ষ করা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পথে দুটি বাধা। বাধা দুটি হল : ১. নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব ও ২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সরকারি বিশেষজ্ঞ মহলে ঘোরতর মতানৈক্য। বোর্ড অব রেভিনিউর সভাপতি ও কাউন্সিলর জন শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে আপাতত এক বা দুদশকের জন্য একটি পরীক্ষামূলক বন্দোবস্ত করার পক্ষে জোরাল যুক্তি প্রদান করেন। অবশেষে ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্ত করা হয় |
এ শর্তে যে, কোর্ট অব ডাইরেক্টরস তৎক্ষণাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মত প্রকাশ করলে দশসালা বাবরকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করা হবে। ফলে ১৭৯২ সালের শেষের দিকে কোর্ট অব ডাইরেক্ট্ররা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মতামত দিলে কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ২২ মার্চ দশসালাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বার ঘোষণা করেন। রাজস্ব সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ দুদশকের যে আলোচনা ও পর্যালোচনা তার সমাপ্তি হয়। তাই কর্নওয়ালিসের শাসনামলে এটা বাস্তবায়িত হয় বলে একে এককভাবে তার কৃতিত্ব বললে ভুল হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ জেলা প্রশাসক থেকে সকল প্রকার কর্মচারী ডাইরেক্টর সভা পার্লামেন্টের পরামর্শ ছিল। যা দুদশক পরে বাস্তবায়িত হয়।
বাংলার অর্থনীতি ও সমাজের উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার অর্থনীতি ও সমাজের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঔপনিবেশিক যার কোম্পানির রাজনৈতিক অধিকারকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অর্থবহ করে তুলবার যে তাগিদ তা হতেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভাবনার সৃষ্টি হয়। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসও এটা স্বীকার করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হল : ক. বাংলার অর্থনীতির উপর প্রভাব । ১. কৃষিকার্যের অবনতি বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনে যারা উদ্যোগী হয়েছিলেন তাদের বক্তব্য ছিল যে, এ ব্যবস্থায় কৃষিকার্যের উন্নতি ঘটবে। জমিদারদের জমির উপর ব্যক্তির মালিকানা দেওয়ার ফলে তারা জমির উন্নতির দিকে দৃষ্টি দিবেন। কারণ, জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করলে জমিদারদেরই লাভ। জমিদাররা জমি থেকে রাজস্ব হিসেবে অর্থ উপার্জন করতে সমর্থ হবেন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের বেশ কিছুদিন পরে একথা স্পষ্ট হয়ে উ জমিদারদের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন করা; জমির উন্নতি সাধন নয়। যে কারণে দেখা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষিকার্যের অবনতি ঘটেছিল। ফলে যে উদ্যোগ তা ব্যর্থ হয়।
२ কৃষকরা জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে রাজস্ব আদায়কারী এবং জমিদাররা সকলেই ভূস্বামী বা জমির মালিক বলে বিবেচিত হন। অর্থাৎ, জমিদারি এলাকার সকল কর্তৃত্বই তাদের উপর বর্তায় অন্যদিকে কৃষক বা প্রজারা তাদের জমির উপর অধিকার হারিয়ে সামান্য ভাড়াটিয়া প্রজাতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, এতদিন যে জমিতে ভোগ দখল করেছিল তারা সেটা হতে বঞ্চিত হয়।
৩. অতিরিক্ত রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি প্রথা প্রবর্তনের সময় নিয়ম ছিল যে, কৃষকদের কাছ থেকে আদায়কৃত রাজস্বের ভাগ জমিদাররা সরকারি আদায় হিসেবে জমা দেবেন এবং ভাগ নিজস্ব আয় হিসেবে রাখবেন কিন্তু রাজস্বের পরিমাণ চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হওয়ার ফলে জমিদার পরবর্তীকালে লাভবান হয়েছিল। কারণ, কৃষি এলাকার বৃদ্ধি, রায়তের কাছ থেকে বর্ধিত হারে খাজনা আদায় প্রভৃতির ফলে জমিদারি আয় বৃদ্ধি পেলে তার সুফল কেবল জমিদারগণই ভোগ করত, অপর কেউ নয়। এতে প্রজাদের নানারকম অসুবিধা হয় এবং সরকারেরও আর্থিক ক্ষতি হয়।
৪. অর্থনৈতিক বিকাশ ব্যাহত: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা শোষণের হাতিয়ার ব্যবহার করতে থাকেন। ফলে কৃষির উদ্বৃত্ত মূল্যের প্রায় সবটুকুই কৃষকদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অন্যদিকে মুৎসুদ্দী ব্যবসায়ীদের হাতে যে বণিক পুঁজি ছিল তা শিল্প পুঁজিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায় নি। কারণ, জমিতে অর্থ বিনিয়োগ করে তারা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং তারা জমিদারি ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ফলে অর্থনৈতিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়। ৫. শতকরা ৪০ ভাগ সম্পদ কৃষকদের : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেখা যায় কোম্পানির কাছে তেমন কোন নথিপত্র ছিল না। যে কারণে রাজস্ব নির্ধারিত করা হয়েছিল সরকারের খোয়াল খুশি মত। জমিদারের সাথে আলাপ আলোচনা না করেই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারে সর্বাধিক অর্থ যাতে আদায় করা যায়। স্বাভাবিকভাবে রাজস্ব হিসেবে দেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল অত্যধিক। এমতাবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে দেখা যায় বাংলার মোট উৎপাদনের শতকরা হিসেবে মাত্র ৪০ ভাগ কৃষকদের হাতে থাকত। সরকারের হিস্যা ছিল ৪৫ এবং জমিদার ও অপরাপর মধ্যস্বত্বভোগীদের ১৫ ভাগ।
খ. বাংলার সমাজের উপর প্রভাব :
১. সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রথমে দেখা যায়, এ ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজের সম্পূর্ণ কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। অল্পকথায় বলতে গেলে ইংরেজদের ভারত বিজয়ের অন্যতম প্রধান পরিণতি ছিল যুগযুগ ধরে ভারতীয় সমাজের যে কাঠামো অপরিবর্তিত ছিল একে ভেঙে দিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করা। রজনী পান দত্ত এ পরিবর্তনকে একটি সমাজ বিপ্লবের সাথে তুলনা করেছেন। বলাবাহুল্য বাংলার প্রাচীন ভূমি ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমেই এ পরিবর্তন সূচিত হয়।
২. কৃষি সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি ঃ প্রাচীনকাল থেকে কৃষি ছিল ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং এদের সামাজিক সম্পর্ক কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। ইংরেজরা প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার ফলে সে সামাজিক সম্পর্ক ও পরিবর্তন অনিবার্য হয় । ফলে সামাজিক সম্পর্ক কৃষি সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।
৩. পুরাতন জমিদার ধ্বংস: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রাজস্ব জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের কড়াকড়ি ছিল অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের পূর্বে রাজকোষে অর্থ প্রদানের নিয়ম ছিল। এতে দেখা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত জমিদারদের অনেকেই নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হয় ফলে জমিদারি নিলামে বাতিল হয়ে যায়।
৪. মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সামাজিক প্রভাব ছিল জমিদার ও রায়তের মাঝখানে এক নতুন সামাজিক শ্রেণীর বিকাশ। এ নতুন সামাজিক শ্রেণী হল মধ্যস্বত্বভোগী। এখন জানা দরকার কিভাবে এ মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হল। ইংরেজ সরকারের সাথে জমিদারের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল সময়মত রাজস্ব প্রদান। এর পরিবর্তে জমিদার জমির মালিক হিসেবে জমিদারি নিয়ে কি করবেন তা ইংরেজ সরকারের বিচার্য নয়। এমতাবস্থায় জমিদার আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কোন বিত্তশালী ব্যক্তিকে জমিদারির একাংশ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ইজারা বা লিজ দিতে পারতেন। এই ইজারাদাররাই মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে পরিচিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এর সৃষ্টি হয়।
৫. জমিদারদের অনুপস্থিতিতে প্রজা অত্যাচার বৃদ্ধি : এ ব্যবস্থার ফলে বাংলার প্রাচীন জমিদারদের বিলুপ্তি ঘটেছিল। যে সকল জমিদার গ্রামে বাস করে প্রজাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হতেন তারা নতুন রাজস্ব ব্যবস্থায় পাততাড়ি গুটান। এদের পরিবর্তে সে জায়গা দখল করেন এমন সব বিত্তশালী মানুষ যারা জমিকে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে মনে করতেন। শহরে বসবাসকারী এসব অনুপস্থিতি জমিদারদের জমির প্রতি কোন টান ছিল না। প্রজাদের দুঃখ কষ্টের প্রতি তারা নজর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করা দূরে থাকুক, তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রজাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করা এবং শহরে থেকে আমোদ প্রমোদে দিন কাটানো। গোমস্তাদের মাধ্যমেই তারা জমিদারির কাজ চালাতেন। ফলে প্রজারা অত্যাচারে পতিত হন।
উপসংহার : অতএব বলা যায়, ১৭৯৩ সালে যে কারণে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে পাস করা হয় তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি। তবে কোম্পানির স্বার্থগত দিক থেকে এটা অনেকটা সুফল হয়েছিল। ফলে দেখা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রাজস্ব সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও জমিদারদের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে যে প্রজাদের স্বার্থে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হয় নি। কারণ, প্রজারা এর ফলে অত্যাচারে পতিত হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]