১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আলোচনা কর। কংগ্রেস কি হিন্দু সংগঠন?

ভূমিকা ঃ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায় থেকে ভারতীয়রা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে। ব্রিটিশ সরকারও ভারতীয় জনসাধারণকে দমিয়ে রাখার জন্য একের পর এক আইন পাস করেন। কিন্তু এতে দেখা যায় যে, ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন হচ্ছে না, শুধু উলুবনে মুক্তা ছড়ানো হয় মাত্র। তাই ভারতীয়রা দেখল যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করা ছাড়া ভারতীয়দের দাবিদাওয়া পূরণ হবে না। তাই ভারতীয়রা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবিদাওয়া পুরণের জন্য ১৮৮৫ সালে বড়লাট ডাফরিনের সমর্থনে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এটাই ভারতীয় কংগ্রেস নামে খ্যাত। এ কংগ্রেসকে ভারতীয়দের দাবি আদায়ের প্রথম স্বীকৃত সংগঠন বলা হয়।
কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা : জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে। বিশিষ্ট । স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় ইতিহাস প্রণেতা ডঃ পটভী সীতারামাইয়া এ মত পোষণ করেছেন যে, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অ্যালান অকটাভিয়ান হিউম বড়লাট ডাফরিনের অনুকূলে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যদিকে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এ মত পোষণ করেন যে, জাতীয় কংগ্রেসের উত্তরে বড়লাট ডাফরিনের মুখ্য ভূমিকা ছিল। কারণ, হিউম প্রথমে সামাজিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উপর গুরুত্ব দেন এবং হিউম ডাফরিনের প্রস্তাব অনুসারে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ডাফরিনের চিঠিপত্র ও বিভিন্ন মন্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, তাঁর সাথে হিউমের সম্পর্ক আদৌ মধুর ছিল না। উপরন্তু ডাফরিন মি এর রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার কঠোর সমালোচনা করেন। এছাড়া প্রথম থেকে ডাফরিন কংগ্রেসকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। বোম্বাইয়ে গভর্নরকে লেখা চিঠি (১৭ মে ১৮৮৫) থেকে জানা যায় যে, হিউম কংগ্রেস গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন সত্য কিন্তু কংগ্রেসের যৌক্তিকতা সম্পর্কে ডাফরিনের ঘোরতর সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল। সুতরাং, ডাফরিনকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বলা যুক্তিযুক্ত নয় এবং হিউমকেই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতারূপে গণ্য করা চলে।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি ঃ যদিও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে, তারপরও ঊনবিংশ শতকের সত্তর দশক থেকে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়। এ সময় ভারতে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির মধ্যবিত্তের উত্থান হয়। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। তারা ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার জন্য যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দরকার তা ভারতে ছিল না। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে ইন্ডিয়া লীগ' নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠিত হয়। তবে এ সংস্থা পুরোপুরি সফল হতে পারে নি।
ভারতের সমাজ সচেতন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধনে 'ভারতসভা' নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। সুরেন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারতসভা' ভারতীয় 1. C. S পরীক্ষা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতির ঘোর বিরোধিতা করে। এতে ব্রিটিশ সরকারের বয়ঃসীমা ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করার যে চক্রান্ত তার কঠোর সমালোচনা 'ভারতসভা'র মাধ্যমে করা হয়। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার I. C. S. পরীক্ষার নিয়মকানুন কিছুটা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
ভারতবাসীর মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব যখন প্রকট তখন ১৮৭৮ সালে বড়লাট লিটন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Vernacular Press Act এবং ভারতবাসীকে নিরস্ত্র করার জন্য Arms Act পাস করেন। এ দুটি আইন পাস করার প্রেক্ষিতে ভারতসভা' তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু তা তেমন সফল হয় নি।
বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ বিচারক ও ভারতীয় বিচারকদের মধ্যে যে বৈষম্য ভারতে বিদ্যমান ছিল তা ছিল বিরাট ব্যবধান। এ বিচারব্যবস্থার বৈষম্যকে কেন্দ্র করে যে ইলবার্ট বিল আন্দোলন তা ছিল একটি বড় সমস্যা। এ ইলবার্ট বিলের মাধ্যমে ভারতীয় বিচারক ও ব্রিটিশ বিচারকদের সমান মর্যাদা দান করার প্রস্তাব করা হয়। এ বিলের প্রতিবাদে ইংরেজরা ফেটে পড়ে। এদিকে সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভা ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। শেষে আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ঐতিহাসিক অনিলশীল ইনসার্ট বিলকে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বাভাষ বলে ইঙ্গিত দেন।
১৮৮৩ সালে কলকাতায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এ সময় সুরেন্দ্রনাথের কূটকৌশলে কলকাতায় এক জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রতিনিধিরা যোগ দেন। এ সভায় শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা, বৃহত্তম কর্মসংস্থান, বিচারব্যবস্থার পৃথকীকরণ এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয় ।
১৮৮৫ সালে কলকাতায় জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংস্কার এবং একযোগে ইংল্যান্ড ও ভারতে পরীক্ষা গ্রহণ, অস্ত্র আইন রহিতকরণ, বিচার ও শাসন বিভাগের পৃথকীকরণ এবং সামরিক ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগের ব্যয়ভার কমানো ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয় ।
ভারতীয় সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে যখন এ ধরনের একটি সংঘ গঠন করার পক্ষে জনমত অনুকূলে তখন আবার সরকারি মহলেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এ সময় অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ভারতীয়দের স্বার্থ আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেন। এছাড়া উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন যে তত্ত্ব দেন তাও গ্রহণযোগ্য ছিল। তিনি লেখেন যে, ৩০ হাজার গোয়েন্দা রিপোর্ট পড়ে হিউমের মনে এ আশংকা জন্ম নেয় যে, খুব শ্রীঘ্রই একটি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব অত্যাসন্ন। এছাড়া এ সময় ভারতীয়দের সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যায় যে, পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূলে। তাই তিনি ১৮৮৩ সালে ১ম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠিতে একটি স্থায়ী সংস্থা গঠন করার জন্য উপদেশ দেন। এছাড়া এ ধরনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার সাথে ডাফরিনের মতের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তাই হিউম ডাফরিনের অনুকূলে ১৮৮৫ সালে ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে কংগ্রেস নামে একটি রাজনৈতিক দল ভারতীয় ইতিহাসে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু করে। জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : ১৮৮৫ সালে বোম্বায়ে খ্যাতনামা ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র মহাশয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেসের প্রাথমিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ঘোষণা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্যাবলি ছিল নিম্নরূপ :
১. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ভারতীয়দের মধ্যে যোগসূত্র এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। 2. 9. ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও যোগাযোগের মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও প্রাদেশিকতার সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করা। শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলি চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ নির্ধারণ করা।
৪. আগামী এক বছরের মধ্যে রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা । এছাড়া অধিবেশনের শেষান্তে সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য নয়টি সুপারিশ সম্বলিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হল : ভারতের প্রশাসনের তদন্তের জন্য একটি রাজকীয় সমিতি নিয়োগ করা। ভারত সচিবের পরামর্শ সভার বিলোপ করা।
8. ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস করা ।
৩. কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত জাতীয় সদস্যদের গ্রহণ করা।
C. উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়োগের জন্য ভারতে ও ইংল্যান্ডে একযোগে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা। কংগ্রেস কি হিন্দু সংগঠন ছিল : সুদীর্ঘকাল থেকে ব্রিটিশ শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের বাস্তব প্রতিফলন হিসেবে ভারতবাসীর যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল সে ধরনের মানসিকতা থেকে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্ম হয়। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর বোম্বাইয়ে প্রথম অধিবেশনের সভাপতি উমেশচন্দ্র বলেছেন, সম্প্রদায়, বর্ণ, ধর্মনির্বিশেষে সকল ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে বিকাশ সাধনই কংগ্রেসের লক্ষ্য। অর্থাৎ, ভারতের সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের জন্য কংগ্রেসের দ্বার ছিল উন্মুক্ত। ভারতের মুসলমান জাগরণের অগ্রদূত আধুনিক পুরুষ স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগদান করতে নিষেধ করেন। তবে এ নিষেধ সত্ত্বেও কিছুসংখ্যক মুসলমান কংগ্রেসে যোগদান করেন। কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যদিও মাত্র ২ জন মুসলমান প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় অধিবেশনে ৩৩ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে প্রায় ৬০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে ২০ জন ছিলেন মুসলিম। এছাড়া কংগ্রেসের প্রথম ২০ জন সভাপতির মধ্যে ৪ জন ছিলেন মুসলমান। সুতরাং, কংগ্রেস সুনির্দিষ্টভাবে যে হিন্দু সংগঠন ছিল তা বলা যায় না।
উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, ১৮৮৫ সালে যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় তা একদিনে বা একা কারো উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এ কংগ্রেস গঠনের/প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে মুখ্য কারণ ছিল, সুদীর্ঘকাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ, নির্যাতন এবং ভারতবাসীকে বোকা বানানোর চক্রান্তস্বরূপ বিভিন্ন আইন পাস করা; যেগুলো ভারতীয়দের স্বার্থের পরিপন্থি ছিল। এছাড়া যে কোন বিষয় চিরদিন স্থায়ী হয় না। তাই শোষিত ভারতবাসীর দীর্ঘদিনের চেপে থাকা ক্ষোভের চরম মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হল একটি নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়াস। তাই শেষে অ্যালান অকটাভিয়ান হিউমের প্রচেষ্টায় ভারতবাসীর প্রথম কথা বলার মাধ্যম সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]